এক বছরের বেশি সময় ধরে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে ব্যাপক আগ্রহের মধ্যে সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবসে যা ঘটেছে, তা পুঁজিবাজারে সচরাচর দেখা যায় না।
এক দিনে এই একটি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি, যা গোটা লেনদেনের ৮.৮০ শতাংশ।
গত এক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই লেনদেনের শীর্ষে বেক্সিমকো লিমিডেট। তবে এক দিনে দুইশ কোটি টাকার বেশি শেয়ার বিক্রির বিষয়টি সহসা হয়নি।
সোমবার কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি হয়েছে মোট ২ কোটি ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৭১১টি। দিনভর দাম উঠানামা করেছে ১১৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকৈ ১২০ টাকা ৬০ পয়সার মধ্যে। দিন শেষে এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ২৫৬ কোটি ৮৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
গত এক বছরে এক দিনে আজই সবচেয়ে বেশি শেয়ার হাতবদল হয়েছে, এমন নয়। গত ৪ জানুয়ারি ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৩৩টি শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। তবে সেদিন শেয়ারদর ছিল ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। সেদিন হাতবদল হয়েছিল ২৬০ কোটি টাকার বেশি।
গত এক বছরে কোম্পানিটির সর্বনিম্ন শেয়ারদর ছিল ১৮ টাকা ৮০ পয়সা, আর সর্বোচ্চ দর ১২০ টাকা ৬০ পয়সা।
২০১০ সালের মহাধসে ক্রমাগত দর হারাতে থাকা কোম্পানিটির মুনাফা ২০১২ সাল থেকে ক্রমেই নিম্নমুখী ছিল। তবে করোনার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পিপিই পাঠাতে শিল্পপার্ক করার পর থেকে ঘুরে দাঁড়ায়।
২০১৫-১৬ সালে শেয়ার প্রতি ১ টাকা ৫৬ পয়সা, পরের বছর ১ টাকা ২৩ পয়সা, ২০১৮ সাল আবার ১ টাকা ৫৫ পয়সা, পরের বছর ১ টাকা ৬৩ পয়সা আয় করা কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি আয় করেছিল ৫১ পয়সা।
গত এক বছরে বেক্সিমকো লিমেডেটের শেয়ারদর বাড়ার চিত্র
২০১০ সালে তিন থেকে চারশ টাকায় লেনদেন হওয়া শেয়ার দর এক পর্যায়ে নেমে আসে ১১ টাকা ৮০ পয়সায়।
করোনার মধ্যে গত বছরের ২৯ জুলাই থেকে শেয়ারদর ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর পেছনে ব্যবসা সম্প্রসারণে কোম্পানির বেশ কিছু উদ্যোগ কাজ করেছে।
সরকারি তিনটি প্রকল্পে ৩৫৭ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে কোম্পানিটি। তবে সবচেয়ে বড় চুক্তিটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পিপিই ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী রপ্তানির লক্ষ্যে শিল্পপার্ক করা হয়েছে। এই রপ্তানির পরেই তাদের আয় ক্রমাগত বাড়ছে।
গত তিন বছর মিলিয়েও কোম্পানিটি যত আয় করতে পারেনি, তার চেয়ে বেশি আয় করে ফেলেছে গত ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে। এই সময়ে শেয়ার প্রতি ৪ টাকা ৩০ পয়সা আয় হয়েছে। অথচ ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সম্মিলিত আয় ছিল ৩ টাকা ৫৯ পয়সা।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বেক্সিমকোর আয়ের তথ্য। এই আয় আগের তিন বছরের সম্মিলিত আয়ের চেয়ে বেশি
এই ৪ টাকা ৩০ পয়সা আয়ের মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ১৪ পয়সা। অর্থাৎ এর পরের দুই প্রান্তিকে আয় হয়েছে ৪ টাকা ১৬ পয়সা। ফলে অর্থবছর শেষে শেয়ার প্রতি আয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফনের আশা করা হচ্ছে।
পিপিই পার্ক ছাড়াও কোম্পানিটি দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যাচ্ছে। ইসলামী সুকুক বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে তারা দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেড, যার ৩৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছে বেক্সিমকো লিমিটেড।
এসব উদ্যোগ কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়াবে-এমন আশায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলছেন বিনিয়োগকারীরা। কেবল ব্যক্তিশ্রেণির নয়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। গত জুলাই মাসে চার কোটির বেশি শেয়ার কিনেছেন তারা।
অবশ্য এই সুকুক বন্ডে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আগ্রহ দেখিয়েছেন, এমন নয়। বন্ডে বিনিয়োগের জন্য বেক্সিমকোর শেয়ারধারীদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল কোম্পানি। গত ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ৭৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্য নেয়া হলেও ৭১ জন বিনিয়োগকারী ৫৫ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার আবেদন করে। পরে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদনের সময় বাড়ানো হয়।
সুকুক বন্ড ছেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যাচ্ছে বেক্সিমকো, যা তার আয় বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে
কেবল এই কোম্পানি নয়, বিনিয়োগকারীদের তুমুল আগ্রহ বেক্সিমকো গ্রুপের সব কটি কোম্পানির ক্ষেত্রেই প্রয়োজ্য।
গ্রুপের কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারদর দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে এই সময়ে। সেই সঙ্গে ওষুধ ও রসায়ন খাতের অন্য যে কোনো কোম্পানির তুলনায় বেশি শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে।
বেক্সিমকো লিমিটেডের আড়াইশ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের দিন বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৮ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার টাকার।
এই খাতের ৩০টি কোম্পানিতে মোট লেনদেন হয়েছে ২৬১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে স্কয়ার ফার্মার ৪৪ কোটি ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকার।
গত এক বছরে বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারে সর্বনিম্ন দর ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, আর সর্বোচ্চ দর ২১৬ টাকা ৯০ পয়সা।
ব্যাংক খাতে অনাগ্রহের মধ্যেও বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানা থানা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকার।
এই খাতের ৩২টি কোম্পানিতে এদিন লেনদেন হয়েছে মোট ১৬৪ কোট ৪৫ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে নতুন তালিকাভুক্ত সাউথবাংলায় ১২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
গত এক বছরে আইএফআইসি ব্যাংকের সর্বনিম্ন দর ছিল ৮ টাকা ৮০ পয়সা, সর্বোচ্চ দর ছিল ১৭ টাাক ৯০ পয়সা।
বেক্সিমকো গ্রুপের অপর কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিকে লেনদেন অবশ্য এই খাতের সবচেয়ে বেশি ছিল না। লেনদেন হয়েছে মোট ৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
এই খাতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ফুওয়াং সিরামিকে ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
গত এক বছরে শাইনপুকুরের সর্বনিম্ন দর ছিল ১৩ টাকা ৯০ পয়সা, আর সর্বোচ্চ দর ছিল ৪১ টাকা ১০ পয়সা।