বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৩০ কিলোমিটার রাস্তা ঠিক করছেন রবি মিয়া

  •    
  • ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৯:৪৮

রবি মিয়া সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন হাতে দা আর কাঁধে কোদাল নিয়ে। তার এলাকার আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার রাস্তায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে গেছেন। কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন বিভিন্ন বাড়ির রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায় এমনকি লোকজনের ঘরের ফাঁকে ফাঁকে লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে দিতেন।

একটা লোক ৩০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক একা মেরামত করেছেন সারা জীবন ধরে। তার নাম রবি মিয়া। তার খোঁজে এলাকায় গিয়ে লোকজনের কাছে জানতে চাইলে অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কোন রবি মিয়া? পাগল রবি মিয়া?’

খেয়ালি আর জেদি রবি মিয়ার বয়স এখন ৮০ ছুঁই ছুঁই। বার্ধক্যজনিত রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। চাইলেও আগের মতো ছুটতে পারেন না। সারা দিনে কাটে বিছানায় শুয়ে।

এখনও সন্তানদের সাহায্য নিয়ে হেঁটে চলে যান ঘরের বাইরে। খুঁজে খুঁজে বের করেন কোন গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মেছে, কোথায় একটু মাটি কেটে দিতে হবে।

রবি মিয়া কাজপাগল। এলাকার ছোট-বড় সবার কাছে ‘রবি ভাই’ হিসেবে পরিচিত। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের সোয়াবালি গ্রামে তার বাড়ি, যদিও বর্তমানে বসবাস উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের পূর্ব ইলাসপুর গ্রামে।

রবি মিয়া সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন হাতে দা আর কাঁধে কোদাল নিয়ে। তার এলাকার আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার রাস্তায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে গেছেন। কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন বিভিন্ন বাড়ির রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায় এমনকি লোকজনের ঘরের ফাঁকে ফাঁকে লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে দিতেন।

এলাকার মানুষজনের চোখে, রবি মিয়া পাগল। কোথায় থাকতেন, কোথায় যেতেন কেউ জানত না। সব সময় তাকে দেখা যেত কোথাও রাস্তা ঠিক করছেন বা গাছ লাগিয়ে দিচ্ছেন অথবা ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে দিচ্ছেন।

৩০ কিলোমিটার সরকারি রাস্তায় যেখানেই ভাঙন দেখা দিত, সেখানেই কোদাল হাতে হাজির রবি মিয়া। রাস্তার ভাঙন ঠিক করে দেওয়া, বৃষ্টির পানি জমে গেলে তা চলে যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া, বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপণ করা- এটাই তার কাজ ছিল।

শুধু যে সরকারি জায়গায় কাজ করতেন, তা না। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েও একই কাজ করে দিতেন তিনি।

দুই স্ত্রীর ঘরে রবি মিয়ার আট সন্তান। কিন্তু কাউকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তা নিয়েও তার আফসোস নেই। পৈতৃক কিছু সম্পত্তি ছিল, তা বিক্রি করে পরিবারের খরচ চালিয়েছেন। কারণ নিজে স্বেচ্ছায় কাজ করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজের বা পরিবারের জন্য আয়-রোজগার করতে পারেননি।

টেংরাবাজার ইউনিয়নের পূর্ব ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা মেলে রবি মিয়ার। টিনের ছাউনির ছোট একটি ঘরে মেঝেতে শুয়ে আছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই লাঠি হাতে নিয়ে বের হয়ে এলেন। রুগ্‌ণ শরীর। উস্কখুস্ক লম্বা চুলে অনেকটা বাউল ভাব।

কেমন আছেন জানতে চাইলে আফসোস করে বললেন, ‘কাজ করতে পারি না। বাইরে যেতে পারি না। এলাকার কত রাস্তা হয়তো ভেঙে আছে, বর্ষার কারণে পানি জমে আছে, কিন্তু আমি ঠিক করে দিতে পারছি না। হাঁটতে গেলেই মাথা ঘুরে।’

পাশ থেকে রবি মিয়ার ছেলে যাবেদ মিয়া জানান, ‘বাইরে যেতে না পারলেও বাড়িতে ঠিকই প্রতিদিন গাছের পরিচর্চা করেন। কোদাল নিয়ে কাজ শুরু করেন। এসব না করলে তার ভালো লাগে না। আমরাও বুঝতে পারি, আব্বার সুখ কাজে। তাই ঘর থেকে ধরে বাইরে এনে গাছের চারার পাশে রাখি। তিনি সব অসুখ ভুলে কাজে ডুবে থাকেন।’

রবি মিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে রবি মিয়া একদিন দেখেন, তার এলাকায় শিশু এবং নারীরা একটা রাস্তা খুব কষ্ট করে কাদা মাড়িয়ে পার হচ্ছেন। অনেকটা জায়গা ছিল ভাঙা। রবি মিয়া কোদাল নিয়ে একাই ৪ থেকে ৫ দিন ধরে পাশের জমি থেকে মাটি এনে রাস্তা ঠিক করে দেন।

সেই থেকে একটা ৩০ থেকে ৩৫ বছর প্রতিদিন কোথাও না কোথাও তিনি রাস্তা ঠিক করে গেছেন। আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তায় ছিল তার বিচরণ। হাজার হাজার গাছ লাগিয়েছেন, আবার সেগুলোর যত্ন নিয়েছেন।

কোনো দিন কিছু পাওয়ার আশায় এই কাজ করেননি। শুধু নিজের মনের শান্তির জন্য করেছেন। কাজ করলেই তিনি দুনিয়ার সুখ পেতেন। তবে গাছের কথা উঠতেই রেগে গেলেন রবি মিয়া। একটু চড়া সুরে বলে উঠলেন, ‘চোর সবাই চোর। আমি এত এত গাছ লাগিয়েছি, কিন্তু এইগুলা নাই। আগের দিন লাগিয়ে পরের দিন গিয়ে দেখতাম চুরি হয়ে গেছে। অনেক গাছ তো বড় হওয়ার পরেও চুরি হয়েছে।’

তবে শুরুর দিকে অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল রবি মিয়ার। মানুষ ভাবত, তার বিশেষ কোনো মতলব বা ধান্দা আছে, নয় তো কেউ এভাবে কাজ করে না। সবাই যখন বুঝতে পারল, কোনো স্বার্থ নেই, তখন পাগল উপাধি দিল। রবি মিয়ার বাড়ির পাশের মোকামবাজারের প্রতিটি মানুষের কাছে প্রিয় মানুষ রবি মিয়া।

এই বাজারের ব্যবসায়ী জাফর মিয়া বললেন, রবি মিয়া এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, দাঁড়াতে পারেন না ঠিকমতো। যত দিন শরীরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাজ করতে পেরেছেন, তত দিন তিনি স্বেচ্ছায় কাজ করে গেছেন।

বাজারে বিভিন্ন দোকান ঘরের পাশে যে খালি জায়গা থাকত, তাতে তিনি বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে দিতেন। এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবজির গাছও লাগিয়েছেন। এই কাজের পেছনে তার কোনো চাওয়া ছিল না।

জাফর মিয়া বলেন, ‘এমন মানুষ দেশে আর আছে কিনা জানি না। এই মানুষটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা উচিত। এতে অন্যরা উৎসাহ পাবে।’

প্রচারবিমুখ রবি মিয়ার বিষয়টি নিয়ে অবগত স্থানীয় প্রশাসন। রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা পাল জানান, ‘আমি শুনেছি, তিনি এই এলাকায় অনেক কাজ করেছেন। বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে আমি জেনেছি। তার প্রয়োজনে আমরা সব সময় পাশে থাকব। রবি মিয়ার মতো মানুষ এই সমাজে বিরল। নিজের খেয়ে কেউ স্বেচ্ছায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তা ঠিক করে দেবে– এমনটা আসলে আমরা ভাবতেই পারি না।’

এ বিভাগের আরো খবর