উপসর্গহীন আক্রান্তদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে এ নির্দেশনার আট মাস পেরিয়ে গেছে, তবে বাস্তবে এই টেস্ট শুরু করা সম্ভব হয়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গণটিকাদান কর্মসূচি চলছে। অনেকের শরীরে উপসর্গহীন করোনা রয়েছে। তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না, তা দেখতে অ্যান্টিবডি টেস্ট জরুরি। এমনকি যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা যাচাইয়েও এই টেস্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে গবেষণার কাজে ছাড়া অ্যান্টিবডি টেস্টের পক্ষে নয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সংস্থাটির মহাপরিচালক বলছেন, এই পরীক্ষার যেমন সুবিধা আছে, তেমনই অসুবিধাও আছে। নানা জটিলতার কারণে গবেষণা ছাড়া এই টেস্ট না করোনা ভালো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয় শরীরে অ্যান্টিবডি কী পরিমাণ রয়েছে, বা করোনা প্রতিরোধী টিকা নেয়ার পর অ্যান্টিবডি কতটা তৈরি হয়েছে, তা যাচাইয়ে।
‘অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে আপনার শরীরে কী পরিমাণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে বা আছে, সেটা জানা যায়। অসুবিধার দিক হচ্ছে, অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু হলে অনেক লোক পাওয়া যাবে, টিকা নেয়ার পর যাদের শরীরে কাঙ্ক্ষিত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। আবার অনেকের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। প্রতিটি মানুষের দেহে আলাদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে কারো ৭০ শতাংশ আবার কারো ৮০ শতাংশ অ্যান্টিবডি দেখা যাবে। কারো হয়তো ৪৫ শতাংশ অ্যান্টিবডি দেখা যায়।
‘অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার পর যদি কারো শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি কম পাওয়া যায়, তাহলে তিনি মনে করবেন, সেই টিকার কার্যকারিতা অনেক কম। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে অ্যান্টিবডি টেস্ট করানো সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, শুধু গবেষণা কাজের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট করা ভালো। এটাকে সব জায়গায় উন্মুক্ত করে দেয়া ঠিক হবে না।
তবে অন্য টেস্টগুলো যথারীতি করা হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা আরটি-পিসিআর টেস্ট, জিন এক্সপার্ট টেস্ট করছি– এগুলো দিয়েই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। এই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, অ্যান্টিবডি টেস্ট না করা ভালো হবে।’
দেশে অধিকাংশ হাসপাতালে অ্যান্টিবডি টেস্টের সক্ষমতা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের না চাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক হাসপাতালের সক্ষমতা থাকলেও অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমতি মিলছে না। আমাদের হাসপাতালে এই সক্ষমতা রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনও অনুমতি দেয়নি। অনুমোদন দিলেও অনেক শর্ত দেবে। সেই শর্ত পূরণ করা অধিকাংশ হাসপাতালের জন্য কষ্টকর।’
অধ্যাপক মো. সায়েদুল বলেন, ‘আরটি-পিসিআর টেস্টের ক্ষেত্রেও অধিদপ্তর এমন আচরণ করেছে। ২ হাজার আরটি-পিসিআর টেস্ট সম্পন্ন করতে আইসিডিডিআরবি তিন মাস সময় নিয়েছে। তিন মাস পর আরটি-পিসিআর টেস্ট শুরুর দিনেই আমাদের হাসপাতাল ২ হাজার টেস্ট করিয়েছে।’
দেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। এরপর থেকেই বিশেষজ্ঞরা এ ভাইরাসে আক্রান্তের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না, তা জানতে অ্যান্টিবডি টেস্টের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে সরাসরি করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যায় না। তবে যারা উপসর্গহীন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের রোগ-পরবর্তী অ্যান্টিবডি যাচাইয়ের ভিত্তিতে শনাক্ত করা সম্ভব। শরীরে নির্দিষ্ট কোনো রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, সেটি জানতে এ ক্ষেত্রে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে আরটি-পিসিআর টেস্টের ওপরই নির্ভর করছিল সরকার। তবে পরীক্ষার হার বাড়াতে ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্ত হয় অ্যান্টিজেন টেস্ট।
দেশে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি গত ৩ জুন এক সভায় র্যাপিড টেস্টের সুপারিশ করে। কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, করোনা সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা জানতে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করা দরকার। এর মাধ্যমে সংক্রমণের পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। সংক্রমণ বুঝতে হলে অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করা জরুরি।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস উপসর্গহীনভাবে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। উপসর্গহীন আক্রান্তদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা এই টেস্ট ছাড়া বলা যায় না। এ জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট খুব জরুরি।