১৫ মাস ধরে উৎপাদন চালুর তথ্য গোপন করা তাল্লু স্পিনিং মিলসের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা খতিয়ে দেখছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
আইন অনুযায়ী, এই কর্ম লাইসেন্স বাতিলের মতো অপরাধ।
কোম্পানিটি ২০২০ সালের ৩১ মে ঢাকা ও চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জকে নোটিশ দিয়ে জানায়, ওই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে তাদের উৎপাদন বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে তা।
গত ২৯ আগস্ট ডিএসইতে কোম্পানিটি জানায়, তাদের উৎপাদন ২০২০ সালের ৬ মে থেকে চালু আছে।
তখনই প্রশ্ন আসে, ৬ মে থেকে উৎপাদন চালু থাকলে ৩১ মে কীভাবে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় যে, কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ!
পুঁজিবাজারের বিধিবিধান অনুযায়ী উৎপাদন বন্ধ বা চালুর বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হয়। তাল্লু উৎপাদন বন্ধ করার নোটিশ দিলেও চালুর নোটিশ দেয়নি ১৬ মাসেও। এটি স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন আর এ ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান বেশ আছে।
উৎপাদন বন্ধের নোটিশ আসার পর দর হারানো তাল্লুর শেয়ারদর সম্প্রতি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে
কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ করার নোটিশে এর শেয়ার দাম হারায় ব্যাপকভাবে। একপর্যায়ে তা ৫ টাকার নিচে নেমে আসে। গত জুন থেকে সেই কোম্পানির শেয়ারদরই তরতর করে বাড়ছিল। বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদর এভাবে বাড়বে কেন, এমন প্রশ্ন তখনই বড় হয়।
তাল্লুর ২৯ আগস্টের বিজ্ঞপ্তিতে এটা স্পষ্ট হয় যে, কোম্পানির উৎপাদন যে চালু, সেই বিষয়টি কেউ না কেউ জানত।
‘আইনবিরুদ্ধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ’
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানি যখন করোনার কারণে উৎপাদন বন্ধ করেছে সেটি বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে, তা আইন অনুযায়ী ঠিক আছে। কিন্তু তারপর যখন উৎপাদন আবার চালু হয়েছে তখনও উচিত ছিল বিনিয়োগকারীদের জানানো।’
তিনি বলেন, ‘কোম্পানির এ ধরনের কার্যক্রম ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের পর্যায়ে পড়ে।’
ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের শাস্তি
একাধিক আইন অনুযায়ী তাল্লুর এ কর্ম শাস্তিযোগ্য। ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিকভাবে লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত হতে পারে। বিএসইসি এই ধরনের সিকিউরিটিজের বিপরীতে জরিমানা বা বাতিল করতে পারে। ২০০৬ সালে বিএসইসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিশন কোনো পরিমাণ উল্লেখ না করে আর্থিক জরিমানা করতে পারবে।
এ ছাড়া এসইসি অধ্যাদেশ ১৯৬৯ অনুযায়ী সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
বিএসইসি যা বলছে
বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে কমিশনের পক্ষ থেকে নজরদারি করা হচ্ছে। তারা কখন কী ঘোষণা দিচ্ছে, আর্থিক অগ্রগতির কী কী বিষয় বিনিয়োগকারীদের জানাচ্ছে, এসব বিষয়ে কমিশন খোঁজখবর রাখছে। একই সঙ্গে যেসব খবরে শেয়ারের দর বাড়ছে সেগুলো আসলেই কোম্পানিতে আছে কি না সে সম্পর্কিত কাগজপত্রও আমরা তলব করছি।’
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি
তিনি বলেন, ‘তাল্লু যেভাবে কোম্পানিটি বন্ধ করেছে আবার চালু করেছে সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এর মধ্যে যদি কোনো ইলিগ্যাল অ্যাক্টিভিটিস থাকে তাহলে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
উৎপাদন চালু হওয়ার নোটিশ ১৫ মাস পরে দেয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি- এমন প্রশ্নে বিএসইসি কর্মকর্তা বলেন, ‘উৎপাদন বন্ধ হওয়ার ঘোষণা দেবার পর আবার যখন উৎপাদন চালু করেছে তারা কেন কোনো নোটিশ করেনি সেটি আমরা খতিয়ে দেখব।
‘এটির জন্য প্রাথমিক কিছু কাজ আছে। সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর বলা যাবে, এটি ইনসাইডার ট্রেডিং নাকি ভিন্ন কিছু।’
উৎপাদনের তথ্য ১৫ মাস গোপন তাল্লুর
২০২০ সালের ৩১ মের সেই নোটিশ, যাতে জানানো হয়, ওই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। এই নোটিশের জবাবে পরদিন তাল্লু জানায়, তাদের কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
এই নোটিশ দেয়ার আগে ৯ কর্মদিবসের মধ্যে ৭ কর্মদিবসই বেড়েছে কোম্পানিটির শেয়ারদর। একটি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদর এভাবে বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না, সে প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে।
২০২০ সালের ৩১ মে ডিএসইতে দেয়া তাল্লুর উৎপাদন বন্ধ রাখার নোটিশ, যাতে জানানো হয়েছে ১৪ এপ্রিল থেকে কারখানা বন্ধ
গত ২৭ জুন দাম বৃদ্ধি শুরুর দিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর নোটিশ দেয়ার দিন মূল্য ছিল ৭ টাকা ৯০ পয়সা। এরপর ৬ কর্মদিবসে ৭ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ১৩ টাকা ৭০ পয়সা হয়ে যায়।
দামের এমন উল্লম্ফনে গত ২২ আগস্ট আবার তাল্লুকে নোটিশ দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এই নোটিশের জবাব আসে এক সপ্তাহ পর। রোববার লেনদেন শুরু হওয়ার আগে আগে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ২০২০ সালের ৬ মে থেকে তাল্লুর কারখানা চালু আছে, যেটি লকডাউনের কারণে ১৪ এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
২০২০ সালের ৬ মে থেকে উৎপাদন চালু আছে, এমন খবর আসার পর তৃতীয় দফা মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে তাল্লুর।
এই নোটিশ আসার দিন শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর তিন কর্মদিবস সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়ে ২ সেপ্টেম্বর দাম দাঁড়ায় ১৫ টাকা। রোববার আরও ৩০ পয়সা দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা।
যা বলছেন কোম্পানিসচিব
তাল্লুর কোম্পানিসচিব মমিনুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ভুল কিছু হয়ে থাকলে বিএসইসি অবশ্যই তা খতিয়ে দেখবে।’
গত ২৯ আগস্ট তাদের নোটিশের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি পুরোদমে কখনও বন্ধ ছিল না। করোনার কারণে কোম্পানির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ ছিল। যেহেতু সেটি বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তাই সেটি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা পরবর্তী সময়ে আবার চালু করা হয়েছে ৬ মে ২০২০।’
গত ২৯ আগস্ট তাল্লুর দেয়া নোটিশ, যাতে বলা হয়, ২০২০ সালের ৬ মে থেকে কারখানা চালু আছে
কোম্পানির উৎপাদন চালু করে গোপন রাখা হলো কি না- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রেখেছিলাম এবং সে সময়ই নোটিশে বলে দেয়া হয়েছিল, সরকারের লকডাউনের সময়সীমা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। ফলে সরকার যখন লকডাউন তুলে নিল, তখন আমরা উৎপাদন চালু করেছি। ফলে এটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের মধ্যে পড়বে না।’
বন্ধ ঘোষণার পর শেয়ার কিনেছেন পরিচালকরা
কোম্পানির উৎপাদন চালু- এই বিষয়টি যখন জানা ছিল না, সে সময় তাল্লুর পরিচালক আতিকুল হক গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এই শেয়ার কেনা হবে বলে জানানো হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জানানো হয় আতিকুল তার শেয়ার কেনা শেষ করেছেন।
কারখানা বন্ধের নোটিশ দেয়ার পর তাল্লুর তিন পরিচালক শেয়ার কিনেছেন
আরেক পরিচালক রাবেয়া খাতুনের ১০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা আসে ১০ ডিসেম্বর। তিনি এই শেয়ার কিনে শেষ করেছেন বলে ঘোষণা আসে ৮ ফেব্রুয়ারি।
তৃতীয় যে পরিচালক শেয়ার কিনেছেন, তিনি হলেন রফিকুল হক। তিনি গত ১০ ডিসেম্বর ২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। তিনিও গত ৮ ফেব্রুয়ারি শেয়ার কেনা শেষ করার তথ্য জানান।