পাখি ডাকা ভোরেই সাইকেল নিয়ে বের হন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মাহমুদুল ইসলাম মামুন। সঙ্গে থাকে বই, গাছের চারা, হাতে থাকে পলিথিনবিরোধী প্ল্যাকার্ড।
তার নেই কোনো বিলাসী স্বপ্ন, নেই হতাশা। নিজের প্রতি বিশ্বাস আর সবার ভালবাসা নিয়েই প্রায় ছয় বছর ধরে পরিবেশবন্ধু ও শিক্ষাকর্মীর কাজ করছেন মামুন।
সমাজ পরিবর্তনে মামুনের বহুমুখী কর্মকাণ্ডে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা মুগ্ধ। এই তরুণ একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ইউএনও।
তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামের প্রয়াত আজহারুল ইসলাম ও মাহমুদা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান মামুন। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন ২০১৬ সালে। স্কুলজীবন থেকে এ ধরনের কাজে ঝোঁক থাকলেও পড়াশোনা শেষে বেড়ে যায় কাজের পরিধি।
উপজেলার গ্রামেগুলোতেই বেশি দেখা যায় তাকে। সহজেই যে কোনো বাড়ির উঠোনে, রাস্তার পাশে, খেলার মাঠে ‘পাঠ প্রকৃতি’র আসর জমিয়ে তোলেন মামুন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তার মুগ্ধ শ্রোতা। আগে পড়তে দেয়া বইগুলো ভালোভাবে পড়ে যারা ফেরত দেন তারা পুরস্কার হিসেবে পেয়ে যান গাছের চারা।
প্রায় ছয় বছর ধরে পরিবেশবন্ধু ও শিক্ষাকর্মীর কাজ করছেন পঞ্চগড়ের মাহমুদুল ইসলাম মামুন। ছবি: নিউজবাংলা
করোনার সময়েও থেমে থাকেনি মামুনের কাজ। করোনা প্রতিরোধে নানামুখি কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন গ্রামবাসীর। মহামারির শুরু থেকে তার পাঠের আসরে শিশু- কিশোররা নিরাপদ দুরত্ব রেখে বসে। যে গ্রামেই মামুন যান শিশু-কিশোররা চটের বস্তা নিয়ে দৌড়ে এসে তিন-চারফুট দূরত্ব রেখে বসে পড়ে।
মামুনকে দেখলেই কেউ কেউ চেয়ার নিয়ে দৌড়ে আসে। মামুন তাদের কাছে জানতে চান, তারা সাবান দিয়ে হাত মুখ পরিষ্কার করে কি না, সকালে লেবু পানি পান করছে কি না। শিশু-কিশোরদের অভিভাবকরা জানান, তারা মামুনের কথা মেনেই কাজ করেন। এসব ভালো কাজের জন্যেও মামুন গাছের চারা পুরস্কার দিয়ে থাকেন।
মামুনের উপহার দেয়া দেশীয় ফল গাছের উপকার পেয়েছেন গ্রামের লোকেরা। এখনও মামুন ফলের গাছ উপহার দিয়ে বুঝিয়ে চলছেন, দেশীয় ফল কীভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে করোনা প্রতিরোধে মূখ্য ভুমিকা পালন করে। বড়দের করোনার টিকা নিতেও উদ্বুদ্ধ করেন তিনি।
বন্য পশুপাখি শিকার বন্ধেও কাজ করছেন মামুন। তার ফেসবুক ওয়ালে বিভিন্ন সময়ে শিকার হওয়া পাখি মুক্ত করার পোস্ট দেখা গেছে। পাখিদের মুক্ত করার পর শিকারিদের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন গাছ।
মামুনের এসব কাজ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। গত বছর ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম -ইউএনডিপি বুক মামুনকে জলবায়ু ও শিক্ষা কর্মী হিসেবে ‘হিরো ট্রান্সফর্মার’ উপাধি দিয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের চেনাজানা অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচার হয়েছে মামুনের কাজ।
একটি দৈনিক পত্রিকায় মামুনের ‘পাঠ প্রকৃতি’র আসরের ছবি ছাপা হলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তাকে এক লাখ টাকা অনুদান দেন। এছাড়া দেশ বরেণ্য সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও মোহিত কামাল মাঝে মাঝে তাকে বই ও পত্রিকা পাঠান।
বছরের পর বছর ধরে মামুনের এসব কাজের খরচ চলে তার নিজের হাঁস-মুরগির খামার ও সবজি চাষ থেকে আয় করা টাকা দিয়ে।
মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব কাজ আমার ইবাদতের মতো। প্রতিদিন এক হাতে দশ রকম কাজ করেও ডোনেশনের আশায় বসে থাকিনি। তবে কাজকে পাশে রেখে বিভিন্ন সময় সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবে দিন শেষে আমি আমার কাজ করে খুশি।’
মামুনের কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য জেলা প্রশাসন একাধিক বার পরিবেশ বিভাগে বরাবর চিঠি পাঠালেও মেলেনি কোনো সাড়া।
মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা দিক। মামুনের বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সম্পদের দিকে অসাধুদের নজর পড়েছে। আতঙ্কে থাকি, আমার কাজপাগল ছেলেটার না কোনো ক্ষতি করে দেয় তারা।’
মায়ের কথা টেনে মামুন বলেন, ‘আমি চিন্তা করি আম্মাকে নিয়ে। কদিন আগে তারা আম্মাকে একা পেয়ে হুমকি দিলে তার ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়। আম্মা এমনিতেই হাড় ক্ষয়ের রুগী। আব্বাকেও এমন করে এলাকার অনেকে জ্বালাতন করত। অসময়ে আব্বা স্ট্রোক করে মারা গেছেন। আম্মাকে হারাতে চাই না। আম্মা আমাকে অনেক সার্পোট দিয়েছেন।
‘আমি নিজের মতো নিশ্চিন্তে দেশের কাজ করে যেতে চাই, ডোনেশনও চাই না। বিনে পয়সায় দেশের জন্য কাজ করে শুধু প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা চাই।’
‘তেঁতুলিয়া শিশু স্বর্গ’ সংঠনের প্রতিষ্ঠাতা কবীর আকন্দ বলেন, ‘মামুন একটি বহতা নদীর স্রোত। যার আদর্শিক গন্তব্য রয়েছে। মানুষের মাঝে বোধ ও ভালবাসা বিলিয়ে, দেশকে ভালবাসে সে এগুবেই।’
তেঁতুলিয়ার ইউএনও সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘মামুন গাছের চারা ও বই বিতরণ এবং ছোট শিশুদের পাঠদান করছেন। যারা পড়তে পারে না তাদের জন্য বই পাঠের আসর বসান। এই তরুণ একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।’