বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পরীমনির তিন দফা রিমান্ড কতটা স্বাভাবিক

  •    
  • ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:৪২

গ্রেপ্তারের পর তিন দফায় রিমান্ডে পাঠানো হয় অভিনেত্রী পরীমনিকে। এতে আইন ও নজিরের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে আইনজীবীরা মনে করেন। বিশেষ করে তৃতীয় দফার রিমান্ডের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি মানা হয়নি বলে মনে করছেন তারা।

মাদক আইনের মামলায় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দফায় রিমান্ডে দেয়ার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আইনজীবীরা। এ রকম মামলায় বারবার রিমান্ডে দেয়ার নজির নেই বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তা ছাড়া রিমান্ড দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন ঘটেছে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।

পরীমনিকে গত ৪ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। ৫ আগস্ট তাকে আদালতে উপস্থিত করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। ১০ আগস্ট চার দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে তাকে আবার দুই দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ড শেষে ১৩ আগস্ট তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত। এরপর ১৯ আগস্ট তার উপস্থিতিতে রিমান্ড ও জামিন শুনানি হয়।

তাকে তৃতীয় দফায় একই মামলায় এক দিনের রিমান্ড দেয়া হয়। তৃতীয় দফা রিমান্ডটি ছিল পরীমনি গ্রেপ্তার হওয়ার ১৬তম দিনে। আইনজীবীরা বলছেন, বিদ্যমান আইনে এটি অবৈধ। কেননা গ্রেপ্তারের পর ১৫ দিন পেরিয়ে গেলে কাউকে রিমান্ডে নেয়া যায় না।

তাছাড়া, পরীমনিকে তিন দফায় রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। রিমান্ডের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা নেই যে, এই ১৫ দিনের মধ্যে কয় দফায় রিমান্ডে নেয়া যাবে। তবে একই মামলায় তৃতীয়বার রিমান্ডে নেয়া, তাও ১৬তম দিনে- এসব নজির এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি বলে জানান পরীমনির আইনজীবী মজিবর রহমান।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন যে, রিমান্ড এককালীন ১৫ দিনের বেশি হবে না। তবে পরীমনির কাছ থেকে কিছু উদ্ধার হওয়া বা অন্য কোনো অগ্রগতি না থাকার পরেও তাকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি ছিল অবৈধ।

গ্রেপ্তারের ১৫ দিন পর রিমান্ড হয় না যে কারণে

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, দেশে বিদ্যমান আইন অনুসারে, কোনো ব্যক্তি আমলযোগ্য অপরাধে গ্রেপ্তার হলে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৬৭ ধারার অধীনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম আদালতে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করতে পারেন।

তবে আমলযোগ্য অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির রিমান্ডের মেয়াদকাল কত হবে, কিংবা গ্রেপ্তারের কত দিন পর তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন কর যাবে, তা পরিষ্কার করা হয়েছে আইনে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, আমলযোগ্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মামলার প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিতে চান, তাহলে অবশ্যই গ্রেপ্তার হওয়ার তারিখ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিমান্ডের আবেদন করতে হবে। তা না হলে সেই আবেদন করার কোনো আইনগত ভিত্তি থাকবে না।

এ জন্য পরীমনিকে গ্রেপ্তারের ১৫ দিন পার হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম আদালতে তাকে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন আইনগতভাবে নাকচ হওয়ার কথা।

আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘এ বিষয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলায় এই ১৫ দিন মেয়াদের সীমারেখাকে ১৬৭ ধারার ব্যাখ্যায় নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের ৮ মে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বনাম অনুপম জে. কুলকার্নি মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক সিদ্ধান্তে রিমান্ডের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

ওই ঘটনায় মুম্বাইয়ের চার বিশিষ্ট হীরক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করার দায়ে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় অনুপম জে. কুলকার্নি নামের একজন আসামিকে ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। মামলাটি রেকর্ড হওয়ার পর এটির তদন্তভার পেয়েছিল ভারতের সবচেয়ে সুদক্ষ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।

গ্রেপ্তারের পর সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে পরদিন অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ৫ অক্টোবর দিল্লির মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করেন। রিমান্ড আবেদন না থাকায় বিচারক আইন অনুসারে মামলা শুনানির জন্য ১১ অক্টোবর তারিখ দিয়ে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টিআই প্যারেডের জন্য অনুপম জে. কুলকার্নিকে ১০ অক্টোবর সহযোগিতা করতে বললে তিনি তাতে অস্বীকার করেন। পরে সিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা ১১ অক্টোবর ধার্য তারিখে আদালতে রিমান্ডের আবেদন করেন।

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট বিচারক ওই আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করলে আসামি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসা নেয়ার পর তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।

এর মধ্যে সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমোদিত রিমান্ড ব্যবহারের জন্য আসামিকে পুলিশ হেফাজতে নেননি। ওই তারিখের পর আসামিকে পুলিশের রিমান্ডে নেয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে। এ ক্ষেত্রে আদালত ১৯৮২ সালের রাষ্ট্র (দিল্লি প্রশাসন) বনাম ধর্মপাল মামলার নজিরের কথা উল্লেখ করে আদেশ দেয়।

ওই আসামিকে পুলিশ হেফাজতে না দেয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মামলাটি পরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে উঠেছিল।

সে সময় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আরও মামলার প্রাসঙ্গিক রায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেয়, আসামিকে গ্রেপ্তারের তারিখ থেকে ১৫ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর সিআরপিসি ১৬৭ ধারার উপধারা ২ অনুসারে কোনোভাবেই তাকে পুলিশ রিমান্ডে দেয়া বৈধ নয়।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি ভারতের সিআরপিসি বাংলাদেশেও বিদ্যমান। বিশেষ করে ১৬৭ ধারায় রিমান্ড বিষয়ে একই কথা বলা হয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৬৭ ধারার ব্যাখ্যা ছাড়াও পিআর (পুলিশ রেগুলেশন) ১৯৪৩-এর ৩২৪ প্রবিধানের (জে) উপ-প্রবিধান অনুসারে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রথম হাজির করার তারিখ থেকে ১৫ দিন পর একজন বন্দির কোনোভাবেই পুলিশ রিমান্ডে থাকার কথা নয়।

এই পিআর ১৯৪৩ আইনটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। কারণ পিআর ১৯৪৩-কে পুলিশের জন্য ‘বাইবেল’ বলা হয়।

১৫ দিনের বেশি রিমান্ডে রাখতে না পারার আরেকটি বাধ্যবাধকতা আছে পিআর ১৯৪৩-এর ২৬১ প্রবিধানে। সেখানে বলা হয়েছে, যেকোনো মামলা তা যতই কঠিন হোক না কেন, তদন্তের সময়সীমা হবে ১৫ দিন।

এ ছাড়া ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস ২০০৯-এর ৮৪ বিধি অনুসারে, একজন আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার তারিখ থেকেই হাজতি হিসেবে গণ্য হন।

এ বিষয়টি নিয়ে ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের সিভিল আপিল নম্বর ৫৩ মামলার রায়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গ্রেপ্তারের তারিখ থেকে ১৫ দিন পরে কোনো ব্যক্তিকে কোনোভাবেই ডিটেনশন কিংবা পুলিশ রিমান্ডে পাঠানো বৈধ নয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিষয়টিকে শুধু অবৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং বলেছে, এর লঙ্ঘন হলে তা সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী পারভেজ হাসেম বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা কোনো অবস্থায় ২৪ ঘণ্টার বেশি তার জিম্মায় রাখতে পারবেন না।

এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পরলে এবং গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর হলে এবং আরও তথ্য উদঘাটন মামলার জন্য অতি আবশ্যক মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড চাইতে পারেন। তবে এই রিমান্ড ১৫ দিনের বেশি হতে পারবে না।

এ বিভাগের আরো খবর