স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নজরে আসতে নিজেদের মোটরসাইকেল থাকা দরকার। এমন চিন্তা থেকে টাকার সন্ধান করতে থাকেন হৃদয় হোসেন, সাদ্দাম হোসেন ও নাজমুল হোসেন নামের তিন তরুণ।
পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নেন কাউকে জিম্মি করে মুক্তিপণের মাধ্যমে টাকা আদায় করবেন। আর ওই টাকা দিয়েই রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে আসতে মোটরসাইকেল কিনবেন তারা।
জিম্মি করার মতো লোক খুঁজতে থাকেন তারা। সেই সঙ্গে তিনজনই সিদ্ধান্ত নেন, অপহরণকৃত ব্যক্তিকে তুলে নেয়ার পর প্রথমে হত্যা করবেন এবং হত্যার শিকার ব্যক্তির পরনের পোশাক চিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবেন।
এমন সিদ্ধান্তের একপর্যায়ে এলাকার দুজনকে টার্গেট করেন তারা। কিন্তু বয়সে বড় হওয়ায় তারা টার্গেট পরিবর্তন করে আল আমিন নামে সাত বছরের এক শিশুকে বেছে নেন।
তাকে কৌশলে অপহরণ করেন ওই তরুণেরা। এরপর কালক্ষেপণ না করে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে তারা হত্যা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে তারা ধরা পড়েন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জালে। ঘটনাটি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মানিকগঞ্জ ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর আলম।
শিশু আল-আমিনকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার তিন তরুণ। ছবি: নিউজবাংলা
শিশু অপহরণ ও বস্তায় মরদেহ
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত ২৮ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে শিশু আল-আমিন মানিকগঞ্জে তার বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তার ওপর বাইসাইকেল চালানোর জন্য বের হয়। কিন্তু এক ঘণ্টা পার হলেও সে বাড়িতে ফিরে না আসায় তার মা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। বাড়ির আশপাশ ও সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও শিশুটিকে পাওয়া যায়নি। পরদিন তার বাবা শহিদুল ইসলাম সিংগাইর থানায় গিয়ে ছেলের নিখোঁজসংক্রান্ত জিডি করেন।
৩১ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে প্রতিবেশীরা বেরুন্ডি গ্রামে টেমা মিয়ার পরিত্যক্ত ভিটায় একটি বাঁশঝাড়ের মাঝে শিশুর পরিহিত গেঞ্জির অংশ, প্যান্ট ও মাছির আনাগোনা দেখতে পান। সন্দেহ হওয়ায় বাঁশপাতা সরিয়ে মাটি খুঁড়ে একটি প্লাস্টিকের বস্তায় আলামিনের মৃতদেহ পান স্বজনরা।
শিশু আল-আমিনকে হত্যার পর তার ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
যেভাবে অভিযুক্তদের ধরা হলো
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিশু আল-আমিন হত্যাসংক্রান্ত বিষয়ে ওই দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তা সেটি তাদের নজরে আসে। তারা ছায়া তদন্ত শুরু করেন এবং ঘটনার সম্ভাব্য সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় লোকজনকে চলে জিজ্ঞাসাবাদ।
শিশু আল-আমিনের সেদিনের চলাফেরার সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে হৃদয়, সাদ্দাম ও নাজমুল নামে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে শনিবার সকালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এসপি জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিন তরুণ জানান, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য যে কাউকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করেন তারা। এ জন্য তারা তিনজন প্রথমে এলাকার অন্য দুটি শিশুর যেকোনো একজনকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাদের বয়স বেশি হওয়ায় অপহরণের চিন্তা বাদ দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘তাদের মুক্তিপণ আদায়ের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেপ্তার আসামি হৃদয় শিশু আল-আমিনকে বন্যার পানি দেখানোর কথা বলে সাপের ভিটায় (বড় বাঁশঝাড়) নিয়ে যান। সেখানে নাজমুল আগেই অবস্থান করেন। তারা দুজন প্রথমে আল-আমিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এরপর নাজমুলের কাছে থাকা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে মৃতদেহ ঢুকিয়ে ফেলেন।
‘আল-আমিনের পরনের গেঞ্জি ও প্যান্ট তারা মুক্তিপণ আদায়ের প্রমাণ হিসেবে খুলে রাখেন। এরপর মরদেহের বস্তাটি বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি জায়গায় প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবিয়ে রেখে একটি মুরগির নিটারের (বর্জ্য) বস্তা দিয়ে চাপা দেন। এ সময় নাজমুলের ফোন থেকে সাদ্দামকে ফোন দিয়ে হৃদয় বলেন যে কাজ হয়ে গেছে।’
হত্যার পর এই বাঁশঝাড়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল আল-আমিনের মরদেহ। ছবি: সংগৃহীত
ঘটনার পর আল-আমিনের ব্যবহৃত সাইকেল দিনের বেলায় হৃদয় ও নাজমুল লুকিয়ে রাখেন এবং ওই দিন রাতে হৃদয়দের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরে ফেলে দেন। তারা ২৮ আগস্ট আল-আমিনকে হত্যা করলেও ৩০ আগস্ট হৃদয় যে ডোবায় বস্তা পুঁতে রেখেছিলেন সেই বস্তা পানির নিচ থেকে তুলে পাশেই শুকনা জায়গায় মাটিতে গর্ত করে আবারও পুঁতে রাখেন। যে কারণে স্থানীয়রা ওই দিন মৃতদেহ খুঁজে পান।
এসপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ওই তরুণদের পরিকল্পনা ছিল শিশুটিকে হত্যার পর নতুন সিম থেকে শিশুর স্বজনদের ফোন দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবেন। কিন্তু সাদ্দাম ঘটনার দিন নতুন সিম সংগ্রহ করতে না পারায় আল-আমিনের বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি তারা। তাই তারা মুক্তিপণও চাইতে পারেননি। মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই স্থানীয়রা শিশুটির মৃতদেহ পেয়ে যাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন।’
তিনি বলেন, ‘তারা পালানোর জন্য প্রথমে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের একটি হোটেলে ওঠেন। সেখানে হোটেল বয়ের ফোন থেকে ওই শিশুর বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চান হৃদয়, কিন্তু তারা ভয়ে ছিলেন যেকোনো সময় ধরা পড়বেন। তাই মুক্তিপণ চাইলেও তারা ওই দিন সাভার থেকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে চলে যান।
‘তারা চেয়েছিলেন সেখানে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যাবেন, কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য যাদের সহযোগিতা প্রয়োজন তাদের পর্যাপ্ত টাকা দিতে না পারায় তারা পালিয়ে ভারত যেতে ব্যর্থ হন। পরে সেখান থেকে তারা রাজবাড়ীতে পালিয়ে যান। সেখানে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে পিবিআইয়ের জালে ধরা পড়েন।’