ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার চার জঙ্গির একজনের সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সংগঠনকে চাঙা রাখতে অর্থের প্রয়োজনে জঙ্গিরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বর্ণালংকারের দোকানে লুটপাটের টার্গেট করেছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-১৪-এর আকুয়া বাইপাস কার্যালয়ে রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক অধিনায়ক খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- ময়মনসিংহের জুলহাস উদ্দিন, মো. আলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ রোবায়েদ আলম ও রংপুরের মো. আবু আইয়ুব।
তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৩ রাউন্ড গুলি, ৮টি বোমা সদৃশ বস্তু, ৪টি ব্যাগ, লক ব্রেকিংসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা।
সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মো. রোকনুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতির জন্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এ জন্য জামালপুরের একটি গোপন আস্তানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের।’
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ময়মনসিংহের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বর্ণালংকারের দোকান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে একটি টার্গেট ঠিক করেছিল। জল ও স্থলপথ হয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছার পরিকল্পনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে নৌকা, মাইক্রোবাস ও বাইক অন্তর্ভুক্ত ছিল। লুট করা অর্থ ময়মনসিংহের একটি এলাকার অপর একটি দলের নিকট হস্তান্তর করার পরিকল্পনা ছিল।
তারা আরও জানান, চলতি বছরের গত ৩১ আগস্ট জামালপুরের মাদারগঞ্জের একটি আস্তানায় তারা জড়ো হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে জামালপুরের জামতলা চর এলাকা থেকে ব্রাহ্মপুত্র নদ দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রা করে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন চরে যাত্রাবিরতি করে। এরপর মধ্যরাতে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকায় পৌঁছায়।
ডাকাতির নেতৃত্বে ছিল গ্রেপ্তার জঙ্গি জুলহাস। তার নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা করেছিল। দলের সদস্যদের হাউস ও লক ব্রেকিংসহ বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হয়।
মো. রোকনুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার চারজনের প্রধান ছিলেন জুলহাস। তিনি ২০০৫ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে আলিম পাস করেন। ২০০২ সালে জামালপুরের একটি মাদ্রাসায় দাখিল পড়ার সময় এক দর্জি মাস্টারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। ওই দর্জির দোকানে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং সেখানে বিভিন্ন উগ্রবাদী ওয়াজ ও গজল শুনতেন। এরপর মুক্তাগাছায় একটি মাদ্রাসায় আলিম পড়ার সময় তিনি জেএমবিতে যুক্ত হন।
সে সময় মুক্তাগাছার একজন আঞ্চলিক নেতার অধীনে তিনি বায়াত গ্রহণ করেন। বায়াত গ্রহণে ১০ জন জেএমবি সদস্য অংশ নেন। এই ১০ জনের কয়েকজনকে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও করেছে। কয়েকজন এখনও আত্মগোপনে আছেন।
অধিনায়ক বলেন, বাংলা ভাই ও শীর্ষ জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীনের সঙ্গে জুলহাসের পরিচয় হয়েছিল। সালেহীন বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে অবস্থানকালে জঙ্গি জুলহাস তাদেরকে বিভিন্ন সহায়তা করতেন। তিনি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় ২ বছর কারাগারে ছিলেন। বাংলা ভাইয়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন জুলহাস।
এরপর তিনি নিজ এলাকায় জঙ্গিবাদ প্রচারের জন্য একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই মাদ্রাসার দুইজন শিক্ষক জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতা থাকায় গ্রেপ্তার হন। তখন তিনি সম্ভাব্য গ্রেপ্তার এড়াতে ২০১২ সালে আত্মগোপনে চলে যান। ফলে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। জুলহাস টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ছদ্মনামে বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদে ইমামতি ও শিক্ষকতা পেশায় থেকে জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন।
গ্রেপ্তার জঙ্গি রোবায়েদ ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। ময়মনসিংহে পড়ার সময় এক সহপাঠীর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর জেএমবিতে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহে একটি নাশকতা মামলায় বেশ কয়েক দিন কারাগারে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ২০১৫ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজিতে এমএ সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রামের ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
তিনি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও টেকনাফের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। শিক্ষকের ছদ্মবেশেও বিভিন্ন এলাকা ও প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ প্রচার করতেন। জেএমবি সাইবার দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি করোনাকালে অনলাইন দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশ কয়েকজনকে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
গ্রেপ্তার জঙ্গি আইয়ুব উত্তরবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি (অনার্স) সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে উত্তরবঙ্গের সাইবার দলের প্রধানের মাধ্যমে জেএমবিতে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি উত্তরাঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে জেএমবি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পান।
দ্রুত স্বল্প শিক্ষিতদের জেএমবিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই মধ্যে তিনি পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নীলফামারিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক, অটোচালক ইত্যাদি শ্রেণির পেশাজীবীদের জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উত্তরবঙ্গের জেএমবি নেতা তাকে ডাকাতিতে নির্বাচিত করার জন্য শীর্ষ এক নেতার কাছে সুপারিশ করেন।
অপরদিকে জঙ্গি আলাল ২০১০ সালে জুলহাসের মাধ্যমে জেএমবিতে যুক্ত হন। জুলহাসসহ যে দশজন একত্রে জেএমবিতে বায়াত নিয়েছিলেন, তিনি তাদের বিশেষ সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। সাংগঠনিক প্রয়োজনে তিনি ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে সফর করেছেন।
গ্রেপ্তার চার জঙ্গির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাব।