বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘ছেলেডা এখনও মসজিদের সামনে গিয়া বাবারে খোঁজে’

  •    
  • ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:১২

তল্লার ওই মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা ক্ষুব্ধ এতদিনেও বিচার শুরু না হওয়ায়। তারা বলছেন, উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদের পাশে একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন ভ্যানচালক মো. মিজান। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে তিনি প্রাণ হারান। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে এক বছর ধরে ভুগছে তার পরিবার।

মিজানের স্ত্রী কুলসুম বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক সময় ঘরে চাল থাকে না। তাই অন্যের বাড়ি থেকে সাহায্য তুলি। তারপরও সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। কারণ আমার তো কামাই নাই। বাধ্য হইয়া সেলাই মেশিন কিনছি। তা দিয়া এখন আমাগো কোনোমতে সংসার চলে।

‘আমার স্বামী সারা মাস ভ্যান চালানোর পর গ্রামে আমাগো জন্য টাকা পাঠাইত। উনি মারা যাওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারি যে সাহায্য পাইছি, তা দিয়া বড় মেয়েরে বিয়া দিছি। আর ছোট মেয়ের বিয়ার জন্য বাকি টাকা জমায় রাখছি। কারণ তাও যদি সংসারে খরচ করি তাইলে মেয়ের বিয়া দিমু ক্যামনে? আমরা তো গরিব; গরিবের দুঃখর শেষ আছে?’

বিস্ফোরণে নিহত হন দিনমজুর মনির হোসেন। তার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার বারদরিয়া গ্রামে। তিনি তল্লায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। তার বোনের বাড়িও একই এলাকায়।

তার বোন আঁখি বেগম বলেন, ‘ভাই মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে তার স্ত্রী। গ্রামে বিভিন্ন কাজ করে কোনো রকম সংসার চালান। আমার ভাইয়ের ৭ বছরের ছেলেডা এখনও তল্লায় আসলে মসজিদের সামনে গিয়া বাবারে খোঁজে। আমরা আমাগো ভাই হারানোর বিচার চাই। সরকার যাতে এ বিচারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে এইটাই আমাগো শেষ প্রত্যাশা।’

বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারান সে সময় মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া রংমিস্ত্রি হুমায়ন কবির। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, ‘যারে দিয়া সংসার চলত, সে-ই তো নাই। বর্তমানে অনেক কষ্ট কইরা সংসার চলাইতে হয়। কারণ আমার এক ছেলে প্রতিবন্ধী, আরেক ছেলে বেকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক টানাটানি কইরা সংসার চলে।

‘বিচার তো চাই। বিচারের অপেক্ষাই তো আছি। কই গ্যাস কোম্পানির কোনো লোকের বিচার হইল না। যাগো স্বজন মরছে আমরা সবাই বিচারের পথ চাইয়া আছি।’

এশার নামাজ চলাকালে সেদিনের ওই বিস্ফোরণে ৩৭ মুসল্লি ও এক পথচারী দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে ৩৪ জন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন চারজন।

মিজান, মনির ও হুমায়ুনের মতো প্রাণ হারানো অন্যদের স্বজনরাও ক্ষুব্ধ এতদিনে বিচার শুরু না হওয়ায়। তাদের অভিযোগ, ঘটনার পর কিছু সহায়তা এলেও তা দিয়ে এক বছর চলা যায়নি। কারণ নিহতদের বেশিরভাগই নিজ নিজ পরিবারের প্রধান ও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা বলছে, অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগের মামলায় আদালতে ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিন দফা আবেদন করেও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি পায়নি সিআইডি। এ কারণে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করতে না পারায় তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না।

মসজিদের বিস্ফোরণের ওই ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল আক্তার নিউজবাংলাকে জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে’ মামলা হয়।

তিনি জানান, তদন্তে গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটির অবহেলা ও স্থানীয় ১০ জন কর্মীর জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া যায়। এদের মধ্যে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।

তবে তিনবার আবেদন করেও তিতাস কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি না পাওয়ায় তাদের লোকজনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পুরো বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভর করছে।

আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, মামলাটি এখন জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। তাই পরবর্তী শুনানির পর বিস্তারিত জানানো যাবে।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক গোলাম ফারুক নিউজবাংলাকে জানান, আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে সিআইডির দেয়া আবেদনের বিষয়ে ঢাকায় তিতাসের লিগ্যাল এইড অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানেন। আঞ্চলিক অফিস থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।

এদিকে মসজিদ কমিটির কয়েক দফা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১ বছরের মাথায় গত ২৯ আগস্ট মসজিদটি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। ছয় শর্তে মসজিদটি খুলে দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ।এর মধ্যে আছে মসজিদের বিদ্যুৎসংক্রান্ত সব কার্যক্রমের সঠিকতা নিশ্চিত করা, মসজিদের পাশে গ্যাসলাইন নেই অথবা গ্যাস লাইন ঠিক আছে এই মর্মে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ, প্রতিটি তলায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি রাখা, মসজিদে একাধিক দরজা রাখার ব্যবস্থা করা, তিন মাস পরপর অনুমোদিত প্রকৌশলী ও এবিসি লাইসেন্সপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান দিয়ে পরীক্ষা করানো ও আপাতত মসজিদটিতে এসির ব্যবহার না করা।

ডিসি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস, ডিপিডিসি, তিতাস ও পুলিশ মসজিদ খোলার বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। এই সরকারি দপ্তরগুলোর কাছ থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনের পর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ছয়টি শর্ত দিয়ে মসজিদটি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত মসজিদ কমিটিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে এই মসজিদের নামাজ পড়ানো হলেও কিংবা নতুন করে নির্মাণ করা হলেও তিন মাস পর জেলা প্রশাসন তা মনিটরিং করবে।’

ডিসি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যদি কোনো আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করে, তাহলে সে ব্যবস্থা করা হবে।

মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর নিউজবাংলাকে জানান, বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে মসজিদটি বন্ধ রাখার কারণে ভেতরের অবস্থা জরাজীর্ণ। বিভিন্ন স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে শুক্রবার জুমার নামাজের মধ্য দিয়ে মসজিদ চালুর কথা থাকলেও তা হয়নি।

তিনি জানান, মসজিদটি এখনও নামাজের অনুপযোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে কমিটির লোকজনের সিদ্ধান্তে নতুন করে সংস্কার কিংবা নতুন করে নির্মাণ করা লাগবে। বিস্ফোরণের ঘটনার দুই দিন পর ফতুল্লা থানার উপপরির্দশক হুমায়ন কবির বাদী হয়ে ‘অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ’ এনে মামলা করেন। ১০ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডি। এ সংস্থা তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারী, মসজিদ কমিটির সভাপতি, ডিপিডিসির মিটার রিডার ও স্থানীয় এক বিদ্যুৎ মিস্ত্রিকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় তদন্তের পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

প্রতিবেদনে বিস্ফোরণের জন্য গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসির স্থানীয় ১০ জন কর্মীর পাশপাশি দায়ী করা হয়েছে মসজিদ কমিটির অবহেলাকেও।

তবে মামলাটিতে তিতাসকে দায়ী করা হলেও তাদের কাউকে চার্জশিটভুক্ত করা হয়নি। ওই সময় সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।

মামলার আসামিদের সবাই জামিনে আছেন।

এ বিভাগের আরো খবর