চার হাত এক হলো। পারিবারিকভাবে যশোরের শারাখোলা গ্রামের মেয়ে রাবেয়া বসরীকে বিয়ে করলেন ঝালকাঠির লিমন হোসেন, যিনি এক দশক আগে র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছিলেন।
দুই লাখ টাকা দেনমোহরে শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে এই বিয়ে পড়ানো হয়। এ সময় বর ও কনেপক্ষের লোকজন নবদম্পতির সুখী-সমৃদ্ধ জীবন কামনায় দোয়া করেন।
প্রতীক্ষিত এই বিয়ে হয় একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে। ছিল না তেমন কোনো সাজসজ্জা। বরপক্ষের সব মিলে ২০-২৫ জন আর কনেপক্ষের ১৫-২০ জনের উপস্থিতিতে শেষ হয় বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা।
দুপুর ১২টার দিকে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস এসে থামে শারাখোলা গ্রামের মোল্লা বাড়ির সামনে। বাবা-মার সঙ্গে গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসেন লিমন। তাকে বরণ করে নিয়ে বসানো হয় ঘরে। কয়েক প্রকার মিষ্টি আর পিঠা দিয়ে অতিথিদের করা হয় আপ্যায়ন।
আত্মীয়স্বজনদের প্রাণোচ্ছল পরিবেশে শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। জুমার নামাজের পর অতিথিদের দেয়া হয় দুপুরের খাবার। মেনুতে ছিল সাদা ভাতের সঙ্গে চিংড়ি, ইলিশ আর খাসির মাংস।
কাবিননামা অনুসারে ১৯ বছর বয়সী কনে রাবেয়া বসরী নওয়াপাড়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি শারাখোলা গ্রামের ইজিবাইকচালক টিটু মোল্লার একমাত্র মেয়ে।
১০ বছর আগে র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছিলেন লিমন হোসেন। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় লিমনের পা হারানোর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। প্রশ্নের মুখে পড়ে র্যাবের অভিযান।
ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের সেই লিমন এখন সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের সহকারী প্রভাষক। বৃহস্পতিবার নিজ বাড়িতে হয় তার গায়েহলুদের আনুষ্ঠানিকতা।
লিমনের বিয়ের মধ্যস্থতা করেছেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ফুয়াদ হোসেন। ড. ফুয়াদ একই সঙ্গে কনে রাবেয়া বসরীর দূর সম্পর্কের চাচা।
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফুয়াদ হোসেন বলেন, ‘লিমন আমার ছাত্র। বর্তমানে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে শিক্ষকতা করছি। সেই সূত্রে বিয়ের মধ্যস্থতা করছি। পাত্রী আমার ভাইজি।’
লিমন দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার পেছনে রয়েছে একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও সৎসাহস- যোগ করেন ড. ফুয়াদ।
লিমনের স্ত্রী রাবেয়া বসরী বলেন, ‘তার সংগ্রামের কথা জেনে আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি। সারা জীবন যেন তার সঙ্গে সুখে সংসার করতে পারি। সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য।’
লিমনের বাবা তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, র্যাবের গুলিতে আমার ছেলে পঙ্গু হয়েছে, সেই বিচার যেন পাই। শান্তিতে বাকি জীবন পার করতে চাই। এ জন্য অতীতের মতো দেশবাসীকে পাশে চাই।আরও পড়ুন: র্যাবের গুলিতে পা হারানো সেই লিমনের বিয়ে
লিমনের মা হানুয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে বিনা কারণে র্যাব গুলি করে। মামলা থেকে মুক্তি পেলেও বিনা কারণে অত্যাচারের বিচার পাইনি। আমার ছেলে পড়াশোনা করে শিক্ষক হয়েছে। বিয়ে দিতে পারলাম এত সমস্যা পার করে। আমার ছেলে যেন তার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন পার করতে পারে। দেশবাসী, আমাদের সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থা যেন অতীতের মতো ভবিষ্যতেও পাশে থাকে।’
লিমনের শাশুড়ি জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘আমাদের চাওয়া-পাওয়া সামান্য। ছেলে শিক্ষিত এ জন্য আমরা খুশি মনে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।’
ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালান লিমনের শ্বশুর টিটু মোল্লা। তিনি বলেন, ‘মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি কষ্ট করে, সামনে ইন্টার পরীক্ষা দিবে। ও যেন স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসার করতে পারে।’
২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নে বাড়ির পাশের একটি বাগানে নিয়ে লিমনের পায়ে গুলি করেন র্যাব সদস্যরা। এরপর লিমনসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিমনের গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলতে হয় ঘটনার তিন দিন পর।
সে বছরই লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম ঝালকাঠি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে মায়ের সঙ্গে গরু আনতে গিয়েছিলেন লিমন হোসেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন র্যাব সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। পরে লুৎফর রহমান নামে এক র্যাব সদস্য লিমনের শার্টের কলার ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন। তখন লিমন তার পা ধরে কেঁদে বলেন, ‘আমি সন্ত্রাসী না, আমি স্টুডেন্ট। পাশের ইটভাটায় আমি কাজ করি। খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাই।’
এরপর লুৎফর রহমান লিমনের মাথায় গুলি না করে পায়ে গুলি করেন। র্যাবের মামলা চলার সময় ঝালকাঠির কারা হাসপাতালে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান লিমন। জামিনে মুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার কাঠালিয়া পিজিএস বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরের বছর মামলা দুটি থেকে লিমনকে বাদ দেয়া হয়।
সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন লিমন। এরপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষা সহকারী পদে যোগ দেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি হয় লিমনের।