বেতন কর্তন, চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ রেষারেষিসহ নানা কারণে হযবরল অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের।
ঋণ জালিয়াতিতে ডুবতে বসা ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা দেয় সরকার। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
কোনো উন্নতি নেই ব্যাংকটির। উল্টো আরও খারাপ হচ্ছে। গভীর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে ব্যাংকটি।
প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনা উৎঘাটনের পর ভেঙে পড়ে একসময়ে লাভের মুখ দেখা ব্যাংকটির সার্বিক কর্মকাণ্ড। মূলধনের জোগান দিয়ে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু বেশ কয়েক বছরেও ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, নিম্নমুখী হয় সব সূচক।
এমন অবস্থায় কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। কমিয়ে দেয়া হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। তারপরই শুরু হয় জটিলতা।
সুযোগ-সুবিধা কমানোর পর সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা। খেলাপি ঋণ আদায় এবং ইমেজ পুনরুদ্ধারে তেমন উদ্যোগ নেই।
এখন আলোচনার বিষয়, ব্যাংকটি কি টিকবে? অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে কি একীভূত হবে? যারা এখন চাকরি ছাড়তে চান, তারা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বেতন কাঠামো অনুযায়ী সুবিধা পাবেন?
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের এখন যে অবস্থা, সরকার মূলধন জোগান দিয়ে বেশি দূর উদ্ধার করতে পারবে না। ব্যাংকটিকে এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বিতরণ করতে হবে। তবে ঋণ দেয়ার আগে কোন প্রকল্পে, কাকে দেয়া হচ্ছে, সে বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজ করতে হবে।’
একীভূত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একীভূত কোনো সমাধান নয়। একীভূত করলে ম্যানেজমেন্টের কী হবে? নতুন ম্যানেজমেন্ট টিমে কারা আসবে, এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে কী ফল আসবে। কোনো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলেও ফলাফল শূন্যই হবে।
‘সুফল পেতে হলে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সব স্তরে দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে। তবে একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করলে তখন সুফলটা ভালো পাওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের বিশৃঙ্খল অবস্থা ঠিক করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকের জনবল আরও কমিয়ে আনতে হবে। কম জনবল দিয়ে কীভাবে ভালো কাজ করা যায়, সে বিষয়টির ওপর নজর দিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে।’
এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমানকে ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা দেয়া হলেও তার উত্তর আসেনি।
নতুন সংকট বেতন কর্তন
কোনোভাবেই উত্তরণ হচ্ছিল না। তাই ২০১৯ সালে কমিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স বা বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন। তারপর থেকেই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড।
দায়িত্ব পালন করেন না ব্যাংকটির অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নেয়া হলেই উচ্চ পর্যায় থেকে সুপারিশ করা হয়। তারপর থেমে যায় সব।
ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, অপরাধ করলে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এতে সমস্যা আরও বাড়ছে।
তিন বছর ধরে বন্ধ আছে পদোন্নতি। এতে চাকরিজীবীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা। যারা এত দিন স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাও এখন সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বদলির ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া হলে কেউ কেউ ক্ষমতা দেখিয়ে সেখানে যান না। কেউ আবার স্থান ছাড়তে চান না। অর্থাৎ যে যার মতো অবস্থায় শুধু সময় পার করছেন।
কোন বেতন কাঠামোতে অবসর
তিন পর্যায়ে চাকরি ছাড়ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বয়সজনিত কারণে অবসরে যাচ্ছেন অনেকে। এ ছাড়া ২৫ বছর চাকরির বয়স হলে স্বেচ্ছায় অবসরে এবং নতুন চাকরি পেলে অনেকেই ছাড়ছেন চাকরি। তবে চাকরি থেকে অবসরে গেলে সুবিধা পাবেন কোন কাঠামো ধরে?
বেসিক ব্যাংকের এক চাকরিজীবী জানান, সম্প্রতি ১০০ জন সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে থেকে ৫০ জন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারা কোন বিধি অনুযায়ী সুবিধা পাবেন, তা এখনও ঠিক হয়নি। চাকরিবিধি অনুসারে সর্বশেষ বেতন ধরে সুবিধা দেয়া হলে তারা যদি মামলা করেন, তাহলে জটিলতা বাড়বে।
অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চাকরি ছাড়ার পর দেখা যাচ্ছে, আমার নামে অডিট আপত্তি রয়েছে। চাকরি থাকা অবস্থায় এ তথ্য কেউ বলেনি। এখন চাকরি শেষ হওয়ার পর কেন এই আপত্তি দেয়া হলো? এটি কি সুবিধা না দেয়ার কৌশল?’
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না জানিয়ে। নতুন অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, পদত্যাগপত্রও জমা দেননি। ফলে ব্যাংকের তালিকায় নাম থাকলেও তারা এখন আর নেই। তিন মাসের বেতন নিয়েই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।’
কোনো ব্যাংকের সঙ্গে কি একীভূত হবে?
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) একীভূত করার খসড়া পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্বল দুটি ব্যাংককে একীভূত করে কোনো লাভ হবে না।
বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক একীভূত করা হলে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। তবে একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করলে তখন সুফলটা ভালো পাওয়া যায়।
এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী বা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে বেসিকের আরও উন্নতি হবে বলে তারা মনে করেন।
কিন্তু এটা নিয়েও তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ একীভূত হলে কী সুবিধা পাবে, কী পাওয়া যাবে না, এটা নিয়ে বেসিকে কর্মরতদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, একীভূত করলেই তো সমাধান হয়ে যাবে না। একীভূত করলে ম্যানেজমেন্টের কী হবে, নতুন ম্যানেজমেন্ট টিমে কারা আসবে, এগুলোর ওপর নির্ভর করবে ফল।
দেয়া হচ্ছে না উৎসাহ বোনাস
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের জন্য উৎসাহ বোনাস প্রদান সম্পর্কিত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নিয়ম অনুসারে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে কর্মচারীদের উৎসাহমূলক বোনাস দেয়া উচিত এবং ব্যাংকগুলো মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হলে কর্মীরা সেটা পাবে না।
নীতিমালায় বলা হয়, কেবল শ্রেণীকৃত ঋণ এবং অন্যান্য সম্পত্তির বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতির ব্যবস্থা করার পরে যখন তারল্যের অবস্থান সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকবে, তখন কোনো ব্যাংক নিট মুনাফার ভিত্তিতে প্রণোদনা বোনাস দিতে পারবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকেই আছে উৎসাহ বোনাস। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বেসিক ব্যাংক। ২০০৭ সাল থেকে সোনালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক উৎসাহ বোনাস দেয়। আর ২০১৩ সাল থেকে এই সুবিধা দেয় অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএলও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দিয়ে থাকে উৎসাহ বোনাস।
তবে নিট ক্ষতির কারণে ২০১৩ সাল থেকে বেসিক ব্যাংক এ সুবিধা দিচ্ছে না। ফলে কর্মরতদের মধ্যে সুবিধা না দেয়াতেও হতাশা তীব্র হয়েছে।
অনিয়মের পরই শোচনীয় অবস্থা
সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল। ওই বছরও ব্যাংকটি প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে। পরবর্তী সময়ে তা কমে ২০১২ সালে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসানের মুখে পড়ে ব্যাংকটি।
অতীতের অনিয়ম জালিয়াতির চূড়ান্ত ধাক্কা লাগে ২০১৬ সালের নিট মুনাফায়। ওই বছর ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালে ৩২৭ কোটি টাকা নিট লোকসান গোনার পর ২০২০ সালেও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে এ ব্যাংক।
সংকট কাটাতে বেসিক ব্যাংককে সরকার থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। তাতেও কোনো কাজে আসছে না।
অর্ধেকেরও বেশি ঋণখেলাপি
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতকরা হিসাবে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে বেসিক ব্যাংক। গত জুন শেষে ১৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হলেও এর মধ্যে খেলাপি ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ৫৩ দশমিক ৯৬ শতাংশই খেলাপি।
মার্চ শেষে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করে ১৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৮ হাজার ৮০ কোটি ৭২ লাখ, যা বিতরণকৃত ঋণের ৫৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
২০২০ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ১৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণেও ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।
ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। গভীর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে বেসিক ব্যাংক।
সারা দেশে ৭২টি শাখা এবং দুই হাজার ৩৪ জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংকটি।