এককালে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুরে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম এখন স্থবির। জেলা কমিটি না থাকায় আড়াই বছর ধরে দলীয় কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। নেতা-কর্মীরাও দিকনির্দেশনা না পেয়ে দ্বিধান্বিত, অন্তঃকোন্দলে বিভক্ত।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। সে বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি করার নির্দেশনা থাকলেও তা আর হয়নি।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর শহরের নছির আহমদ ভূঁইয়া মিলনায়তনে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে জেলা বিএনপির সম্মেলন হয়। সেখানে দুই বছরের জন্য আবুল খায়ের ভূঁইয়াকে সভাপতি এবং সাহাবুদ্দিন সাবু ও হাসিবুর রহমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়া হয়।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। দলের যুগ্ম মহাসচিব ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট চিঠি দিয়ে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেন। সম্মেলন ও কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন।
এমন বাস্তবতায় হয়নি সম্মেলন। পরে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর জেলা কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা বিএনপিতে রয়েছে দুই পক্ষ। একদিকে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া, অন্যদিকে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু।
দুই নেতাই হতে চান জেলা বিএনপির সভাপতি। নিজ অনুসারীদের নিয়ে তারা আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন। দুই নেতার বিরোধের জেরেই কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে বলে ধারণা কর্মীদের।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আসন ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে আবুল খায়ের ভূঁইয়া নির্বাচিত হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করার পর থেকে জেলায় দলটির অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে। একসময় যেখানে জেলার চারটি সংসদীয় আসন, চারটি পৌরসভা ও ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বিএনপির দলীয় প্রার্থীরা, সেখানে এখন দুটি ইউনিয়ন ছাড়া সব ক'টি আওয়ামী লীগের দখলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির সাবেক দুই যুগ্ম সম্পাদক ও দুই সদস্য জানান, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবুকে আহ্বায়ক করে জেলা কমিটি ঘোষণা করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা রয়েছে। তবে সে নির্দেশনা মেনে নিতে নারাজ সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও তার লোকজন। এ কারণে কেন্দ্র কমিটি দিতে চাইলেও পারছে না।
আবুল খায়েরের সমর্থকদের দাবি, জেলা কমিটিতে তার বিকল্প কেউ নেই। তাকে সভাপতি না করলে দলের ক্ষতি হবে।
এ দুই নেতার সভাপতি পদের জন্য অনড় অবস্থানে জেলা বিএনপির অন্তঃকোন্দল এখন প্রকাশ্যে। এর জেরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্মীপুরে পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা পাল্টাপাল্টি ১০টি কমিটি গঠন করে।
জেলা যুবদলের সভাপতি রেজাউল করিম লিটন, সাধারণ সম্পাদক রশিদুল হাসান লিংকন ও জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে কমিটি না থাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে দ্রুত কমিটি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ ব্যাপারী অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালে জেলা কমিটি ভেঙে যাওয়ার পর অনেক নেতা-কর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কবে কমিটি গঠন করা হবে, সেটাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু
জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমান বলেন, কমিটি না থাকায় নেতা-কর্মীরা হতাশ। সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে নির্দেশনা দেবেন, দল তা মাথা পেতে নেবে। যোগ্য, দলের জন্য নিবেদিত এবং আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা নেতাকে দিয়ে কমিটি গঠন করার দাবি জানান তিনি।
জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পায়ে গুলি করা হয়। বাসার সামনে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে।
‘তারপরও দলের জন্য মাঠে আছি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি। এখনও মাঠ ছেড়ে যাইনি। যদি আবুল খায়ের ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে আবার কমিটি করে, নেতা-কর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করবেন।’
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি।