ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিদায় করতে চাওয়া ড. কামাল হোসেন নিজের দল গণফোরামকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারছেন না।
দলের একটি অংশকে বাদ দিয়ে আগামী ৪ ডিসেম্বর বিশেষ জাতীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাদের বাদ দেয়া হচ্ছে, তারাও কাউন্সিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে।
১৯৯২ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের দুই বছর পর নিজেই আলাদা দল গঠন করেন কামাল হোসেন।
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গত রোববার ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে’ সরকারকে বিদায় করার ঘোষণা দিয়েছেন ড. কামাল। বলেছেন, ‘এবার আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শুধু ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধারই করব না, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সংগঠিত হব।’
নিজের দলে বিভেদ রেখে কামালের ঐক্যের ডাক নিয়ে সেই আয়োজনেই বাঁকা কথা বলেছিলেন। এই আয়োজনে দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ও তার অনুসারীদের অনুপস্থিত দেখে বলেন, ‘আজকে এই মিটিংয়ে এসে আমি যেমন আনন্দিত, তেমনি দুঃখিতও বটে। কারণ, আজকে আমি এখানে মন্টুকে দেখছি না, সুব্রতকে দেখছি না, অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে দেখছি না।’
- আরও পড়ুন: ড. কামাল ব্যর্থ নেতা: মন্টু
তবে জাফরুল্লাহর দুঃখ থেকেই যাচ্ছে। গণফোরামকে এক করতে পারছেন না কামাল হোসেন।
গত বছরের নভেম্বরে সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়াকে কেন্দ্র করে যে বিভেদ তৈরি হয়েছিল, রেজা দল থেকে দূরে সরে গেলেও তার অবসান হয়নি।
তখন দলের দুই অংশ পাল্টাপাল্টি কাউন্সিলের তারিখও দিয়েছিল। মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ কয়েকজনকে বাদ দিয়ে দলের কাউন্সিল করাকে কেন্দ্র করেই সেই অবস্থা হয়। যাতে সায় ছিল ড. কামালেরও।
মন্টুর নেতৃত্বে দলের কয়েকজন নেতাও ২৬ ডিসেম্বর আলাদা কাউন্সিলের ঘোষণা দেন। তারা এমনকি ড. কামাল হোসেনকে দল থেকে বাদ দেয়ার ঘোষণাও দেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে গণফোরামের নেতা ডা. কামাল হোসেন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ছবি
তবে দুই পক্ষের কোনো কাউন্সিলই হয়নি। পরে মীমাংসার কথা শুনিয়েছিলেন দলটির দুই পক্ষই। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি দল থেকে পদত্যাগ করেন রেজা কিবরিয়া। তখন দুই পক্ষ এক হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধ আসলে মেটেনি। ড. কামালকে বাদ দিয়ে মন্টুকে গণফোরামের সভাপতি করতে চাইছে একাংশ।
কামাল অনুসারীরা কী করছেন
বুধবার গণফোরামের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি মোকাব্বির খানের সভাপতিত্বে সভায় আগামী ৪ ডিসেম্বর দলের বিশেষ কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য ১০১ সদস্যের পরিষদ এবং ৭টি উপপরিষদ গঠন করা হয়।
বিশেষ কাউন্সিল প্রস্তুতি পরিষদের সদস্যসচিব শাহ্ নূরুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, মন্টুসহ অন্যদের বাদ দিয়েই তারা কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আসলে মনেপ্রাণে ঐক্য না চাইলে ঐক্য হয় না।’
তিনি বলেন, ‘মন্টু ও তার অনুসারীরা ড. কামালের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তারা চাইছিলেন দলের সভাপতি হবেন মন্টু। এটা তো আসলে সম্ভব না।’
মোকাব্বির খান বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘ওনাদের (মন্টু ও তার অনুসারীরা) তো বহিষ্কার করা হয়েছিল দল থেকে। পরে ওনারা একসঙ্গে কাজ করতে চাওয়ায় আদেশ তুলে নেয়া হয়েছিল। তাহলে তো ওনারা গণফোরামেই আছেন।’
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনায় তাদের কেন দেখা যায়নি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওনারা আসেননি ব্যক্তিগত কারণে।’
পর মুহূর্তেই বললেন, ‘হয়তো করোনার কারণে আসেননি।’
মন্টু অনুসারীদের কী বক্তব্য
দলের মধ্যে বিভেদ দিয়ে মন্টুর বক্তব্য জানতে পারেনি নিউজবাংলা। তাকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।
তার অনুসারী আবু সাইয়িদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মিটিং (আজ) করে কর্মসূচি ঠিক করব। এর পর বর্ধিত সভা করে কাউন্সিলের তারিখ দেব।
‘আমরা ড. কামাল হোসেনকে সেই কাউন্সিলে ডাকব। উনি না আসলে ওনার পথ উনি দেখবেন।’
তিনি বলেন, ‘ওনার (ড. কামাল) সঙ্গে লোক নাই জন নাই। ওনাকে বলেছিলাম সবাইকে নিয়ে একটা কাউন্সিল করতে আর উনি আমাদেরকে না জানিয়েই কাউন্সিলের তারিখ দিলেন।’
গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু। ফাইল ছবি
দলে মন্টুপন্থি হিসেবে পরিচিত ও দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক লতিফুল বারী হামিম বলেন, ‘আমরা ড. কামাল হোসেন সাহেবকে একটা চিঠি দিয়েছি। সেই চিঠি দেয়ার পর আবার নতুন করে বিশেষ সম্মেলনের তারিখ দেয়া হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কাজ।’
তিনি বলেন, ‘গণফোরাম সম্পর্কে কামাল হোসেন সাহেবকে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে আমরা জানাচ্ছিলাম। সেটা লিখিত ও মৌখিকভাবে। পরে কামাল হোসেন সাহেব বললেন, আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নাই। আমরা এক সঙ্গে বসলাম। একটি কমিটি করা হলো। পরে ওনাদের পক্ষ থেকে বলা হলো এটা বাড়াতে হবে। কিন্তু আর বসেনি। এটার জন্য দায়ী মোকাব্বির সাহেব।’
মোকাব্বির সাহেব বলেছেন আপনাদেরকে গণফোরাম থেকে বাদ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
হামিম বলেন, ‘উনি বাদ দিতে পারবেন না। দলের সর্বোচ্চ ফোরাম ছাড়া কেউ বাদ দিতে পারেন না।’
ড. কামালকে দেয়া সেই চিঠি
গত ২৫ আগস্ট ড. কামাল হোসেনকে চিঠি দেন মন্টু, আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার, মহসিন রশিদ ও মহীউদ্দিন আবদুল কাদের।
চিঠিতে বলা হয়, গঠনতন্ত্রবিরোধী ও এখতিয়ারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে হতাশা, নিষ্ক্রিয়তা ও দলের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দলকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্বও কামাল হোসেনের।
চিঠিতে বলা হয়, গণফোরাম যাত্রার শুরু থেকেই দলের ভেতর ও বাইরে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল জাতীয় কাউন্সিল করে রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করা থেকে গণফোরামে দ্বন্দ্ব শুরু।
সেই ঘটনা থেকে শুরু করে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার, আলাদা আলাদা কাউন্সিল ডাকা, কেন্দ্রীয় কমিটির সভা না ডাকা, কমিটি ভেঙে দেয়া, রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শফিক উল্লাহকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা এবং সর্বশেষ মোকাব্বির খানকে নির্বাহী সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রসঙ্গ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
নেতারা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২০১৯ সালে জাতীয় কাউন্সিলে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডেকে জাতীয় কাউন্সিল ঘোষণাসহ দলকে রক্ষার জন্য কামাল হোসেনের প্রতি আহ্বান জানান।
কামাল হোসেনের নামের ভার রাজনীতিতে নেই
১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করলেও রাজনীতিতে কখনও আলোড়ন তুলতে পারেননি ড. কামাল হোসেন। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সব সময় বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি আলোচনায় চলে আসেন। সে সময় বিএনপি জোটের সবচেয়ে বড় দল হয়েও ড. কামালকে সামনে নিয়ে আসে। তবে নির্বাচনের পর তিনি গুরুত্ব হারান বিএনপির কাছে। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও এখন নিষ্ক্রিয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামালের গণফোরামের সঙ্গে ওই জোটে ছিল বিএনপি, আ স ম আব্দুর রব নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য।