গ্রাহকের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে, এমন কয়েকটি ডেলিভারি সেবা কোম্পানির বিরুদ্ধে মার্চেন্টদের টাকা আটকে রাখা, উচ্চহারে কমিশন নেয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠার পর এ বিষয়েও একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলায় আনতে চলমান উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার এ বিষয়েও উদ্যোগী হলো।
অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বাসাবাড়ি, করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা কোনো উৎসবে রেডিমেড ফুড সরবরাহ দিয়ে আসছে কিছু ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান। ফুডপান্ডা, সহজ ফুড, পাঠাও, ই-ফুড, হাংরিনাকি, ফুড পিয়ন, ইকুরিয়ার বিডি, হেলদি কিচেন, ফুড মার্ট, হারিকেন এগুলোর অন্যতম।
কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই নেই নিজস্ব শেফ বা ক্রেতার চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী মানসম্মত রেডিমেড ফুড সরবরাহের ব্যবস্থা। ফলে অনলাইনে ক্রেতার চাহিদাসম্পন্ন খাবার অর্ডারটির সরবরাহ পেতে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্বারস্থ হতে হচ্ছে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের কোনো ফাস্টফুড শপ কিংবা মানসম্মত কোনো রেস্তোরাঁতে। আর এখানেই ঘটছে অনিয়মের নানা ঘটনা।
ই-কমার্স খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এখন দৈনিক লক্ষাধিক অর্ডার পেয়ে থাকে। যার অর্থমূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি। এ খাতের বার্ষিক লেনদেন হাজার কোটি টাকার বেশি।
রেস্তোরাঁ মালিকদের অসন্তোষ যে কারণে
অনলাইনে ফুড ডেলিভারি দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তিবদ্ধ ফাস্টফুড শপ বা রেস্তোরাঁ থেকে যখন-তখন রেডিমেড ফুড নিচ্ছে বাকিতে। অপরদিকে ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে রেডিমেড ফুড পৌঁছে দেয়ামাত্র ধার্যকৃত মূল্য পেয়ে যাচ্ছে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি নগদে আদায় করে নিচ্ছে ডেলিভারি চার্জও।
অথচ ওই টাকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেমেন্ট করতে তারা সময় নিচ্ছে এক থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত। এতে খাবার সরবরাহকারী রেস্তোরাঁর মালিকরা নগদ মূলধন বিনিয়োগ করে পেমেন্ট না পেয়ে পড়েছেন সংকটে।
ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা শুধু বকেয়া পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। পেমেন্ট করার সময় উচ্চহারে কমিশনও কেটে রাখছে তারা। এ ক্ষেত্রে প্রতি মূল্য থেকে ন্যূনতম ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই নিয়ে নিচ্ছে কমিশন বাবদ। কমিশনের অঙ্কটা কারও কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি।
প্রতিষ্ঠানগুলো নাখোশ থাকলেও অনলাইন নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সরেও আসতে পারছেন না।
সরকারের কাছে প্রতিকার চেয়ে চিঠি
রেস্তোরাঁ মালিকদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিকার চেয়ে চিঠিও পাঠিয়েছেন।
বিষয়টি নজরে আসার পর কর্মকর্তারা দেখতে পান ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু বিকাশে ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮, ই-কমার্স আইন ও বিধি এবং সর্বশেষ ডিজিটাল কমার্স অপারেশন গাইডলাইন ও ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০২১-এর প্রণীত খসড়ার কোথাও অনলাইনে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মাধ্যমে পরিচালনা করার কোনো সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে।
ওই বৈঠকে ইলেকট্রনিক কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও অনলাইনে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা, পাঠাও, হাংরি নাকি ও ই-কুরিয়ার প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাতে বলা হয়েছে।
যা বলছে মন্ত্রণালয়
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে অনলাইনে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটা নিয়মের মাধ্যমে পরিচালনার বিষয়ে যে ধরনের নিয়ম-নীতিগুলো আমাদের রয়েছে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নাই।
‘মন্ত্রণালয় চায় সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে কমিশন নেবে, সেটি সর্বোচ্চ কত পর্যন্ত নিতে পারবে, কত দিনের মধ্যে ফুড সরবরাহকারী পেমেন্ট পাবে কিংবা ক্যাশ অন ডেলিভারির টাকাটা কীভাবে জমা দেবে, এসব বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে।
‘এই বিষয়টি ই-কমার্স পরিচালন নির্দেশিকার গেজেটে অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০২১ এর চূড়ান্ত খসড়াতেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির বক্তব্য
মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের আগে সংগঠনের অবস্থান নির্ধারণ করতে আগামী শনিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।
সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংগ্রহের পর এর দামটা সময়মতো পরিশোধ করে না। কেউ এক মাস, কেউ দুই-আড়াই মাস পার করে দেয়। এ অবস্থায় রেস্তোরাঁ মালিকদের ব্যবসা চালানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এতদিন ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু পরিচালন নীতিমালার অভাবে আমরা ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কথা জানতে পেরেছি। এখন সরকার একটি পরিচালন নির্দেশিকা জারি করেছে। অর্থাৎ একটি নিয়মের মধ্যে খাতটিকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু সেখানে অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না থাকায় ভুক্তভোগী পাওনাদার বা নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়ও কিছু করতে পারছে না। তবে দেরিতে হলেও মন্ত্রণালয় একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এটি খুব ভালো দিক।’
ইমরান বলেন, ‘সব দেশেই অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো একটি নীতিমালার আওতায় চলে। সেখানে উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়ে থাকে। আমরা চাই সবাই যার যার জায়গায় উইন উইন সিচুয়েশনে ব্যবসা করুক। কারও দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হোক।’
বক্তব্য দিতে নারাজ ফুডপান্ডা
ফুডপান্ডার পেমেন্ট পদ্ধতি, কমিশন রেট সম্পর্কে জানতে প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ শাখার মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠিয়ে যোগাযোগ করেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির জবাব মেলেনি। একজন কর্মকর্তা বলেন, ফুডপান্ডা তার পেমেন্ট পদ্ধতি ও কমিশন রেট সম্পর্কে কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানাতে চায় না।
বিষয়টি নিয়ে ইলেকট্রনিক কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন শিপনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু পরিচালনায় সব বিষয়েই নির্দেশনা থাকবে। ইতোমধ্যে তা জারি করেছে সরকার।
‘তবে কোনো নির্দেশনাই অপরিবর্তিত নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং নতুন নতুন ইস্যুকেন্দ্রিক সমস্যার সমাধানে তা সংযোজন ও বিয়োজন এবং সংশোধনও করা যাবে। অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নীতিমালার আওতায় আনতে একটা সংযোজন জরুরি। মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ ইতিবাচক।’