রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে পার্ক করে রাখা একটি প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে ওই মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।
ইতোমধ্যে তাদের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে শাহবাগ থানা পুলিশ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে তাদের ময়নাতদন্ত করে ভিসেরা নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো কেমিক্যাল পরীক্ষা করে মৃত্যুর সঠিক কারণ বের করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই দুই যুবকের নাম রাকিব ও সিয়াম। নাভানা সিএনজি কনভারশন সেন্টারের পাশে একটি ভাসমান গ্যারেজ রয়েছে, যার মালিক জহির ও বাচ্চু। তারা গাড়ির রঙের কাজ করেন।
রাকিব বাচ্চুর ও সিয়াম জহিরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় তারা কাজের পরও একসঙ্গে থাকতেন।
তারা জানান, মঙ্গলবার সকালে নাভানা সিএনজি কনভারশন সেন্টারের সামনে একটি প্রাইভেট কারের ওপরের কালো কভার সরিয়ে বাচ্চু ও জহির ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সিয়াম ও রাকিবকে ডাকতে থাকেন। ডাকাডাকিতে তারা সাড়া না দিলে তখন পুলিশকে খবর দেয়া হয়। এরপর লক করা গাড়ি ভিন্ন উপায়ে খুলে ভেতর থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
দুই যুবক গাড়িতে কী করছিলেন
রাকিব ও সিয়াম গাড়ির ভেতরে কী করছিলেন সেটি জানতে আশপাশের দোকানদার ও গ্যারেজের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের এক গ্যারেজের মালিক নিউজবাংলাকে জানান, রাকিব ও সিয়াম বেশ কয়েক বছর ধরে বাচ্চুর গ্যারেজে রঙের কাজ করছিলেন। সিয়াম তার চাচা জহিরের সঙ্গে ধোলাইপাড় এলাকায় থাকতেন। রাকিব বাচ্চুর সঙ্গে থাকতেন নন্দীপাড়া এলাকায়।
তিনি বলেন,’সোমবার রাতেও তারা একটি গাড়ির রঙের কাজ করছিলেন। সকালে জানলাম তারা রাতে গাড়িতে ছিলেন আর ওইখানেই মারা গেছেন। তারা দুইজন বন্ধুর মতো ছিলেন।
ওই দুই যুবক প্রায়ই গাড়িতে থাকতেন কি না জানতে চাইলে গ্যারেজমালিক বলেন, ‘আমার তো চোখে পড়েনি কখনও। গাড়িটি যেভাবে কভার দিয়ে ঢাকা ছিল, তাতে বোঝার উপায় ছিল না গাড়িতে কেউ থাকতে পারে। তবে বাচ্চু আর জহির নিশ্চয়ই জানতেন যে, ছেলে দুইটা গাড়িতে আছেন। কারণ তারাই এসে গাড়ির কভার সরিয়ে ডাকতে থাকেন।’
ফোনে কথা হয় গ্যারেজের মালিক ও সিয়ামের চাচা জহিরের সঙ্গে।
তিনি জানান, গাড়িটি একজন কাস্টমার রং করতে দিয়ে গিয়েছিলেন। মঙ্গলবার এই গাড়ির কাজ ধরার কথা ছিল। আগের দিন রাতে অন্য একটি গাড়ির কাজ শেষ করতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাদের কোনো গ্যারেজ নেই, তাই রাস্তার ওপর রেখেই গাড়ি রং করে তারা।
জহির জানান, ওই প্রাইভেট কারটি রাতে রাস্তায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়। গাড়িটি যেন চুরি না হয়ে যায় সে জন্য রাকিব ও সিয়ামকে রাতে গাড়িতে ঘুমাতে বলেন তিনি ও বাচ্চু। আবার গাড়িতে ঘুমাতে দেখলে রাতে কেউ সন্দেহ করতে পারে বা পুলিশ ঝামেলা করতে পারে ভেবে গাড়ি কভার দিয়ে ঢেকে নিতে বলেছিলেন তাদের।
তিনি জানান, এর আগেও কয়েকবার এভাবে তারা দুজন রাত্রিযাপন করেছেন। তবে এবার তারা কীভাবে মারা গেলেন, সেটি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না জহির।
মৃত্যুর কারণ খুঁজছে পুলিশ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাকিব ও সিয়ামের মরদেহ উদ্ধারের সময় তাদের মনে হয়েছিল তারা দুজন বেঁচে আছেন। হাসপাতালে নিলে হয়তো বেঁচে যাবেন। উদ্ধারের সময় দুইজনের মুখ থেকে ফেনাজাতীয় কিছু বের হতে দেখা গেছে।
মৃত্যুর আগে তারা কিছু খেয়েছিলেন কি না বা দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন কি না সবকিছু মাথায় রেখেই তদন্ত করছে পুলিশ।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী ও আশপাশের স্থানীয়রা মনে করছেন, দুইজন যেহেতু গাড়ির ভেতরে ছিলেন, তাই শ্বাসকষ্ট মনে হলে বা গরম লাগলে তারা লক খুলে সহজেই গাড়ি থেকে বাইরে আসতে পারতেন। এভাবে মৃত্যু রহস্যজনক মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলে দুটি কীভাবে মারা গেল সেটি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাবার আগে বলা সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে কোনো মোটিভ বা ক্লু পাওয়া যায়নি। তাদের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি। সম্ভাব্য সবদিক মাথায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখনও হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টিও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ তারা যেহেতু রঙের কাজ করত, তাই জামাকাপড়ে রঙের গন্ধ ছিল। আর কালো কভার দিয়ে ঢেকে রাখা বদ্ধ গাড়িতে একে তো অক্সিজেনের অভাব তার ওপর ওই রঙের গন্ধ। এগুলো গাড়ির ভেতরের বাতাসে মিশে গিয়ে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এসবই আমাদের ধারণা। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব না।’
দুই যুবকের মৃত্যুর ঘটনার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক আব্দুল জব্বার।
তিনি নিউজবাংলাকে জানান, দুই যুবককে উদ্ধারের সময় তাদের একজনের মুখে সামান্য ফেনাজাতীয় কিছু দেখা গিয়েছিল। তাদের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাদের সঙ্গে কোনো মাদকও ছিল না। দুই যুবকের মোবাইল ও মানিব্যাগ ফরেনসিক করতে সিআইডি নিয়ে গেছে। একই সঙ্গে প্রাইভেট কারটি জব্দ করা হয়েছে।’
মৃত্যুর কোনো সম্ভাব্য কারণ ধারণা করা যাচ্ছে কি না প্রশ্নের জবাবে উপপরিদর্শক আব্দুল জব্বার বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টির পাশাপাশি অন্য সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সকলকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে।’
নিহত সিয়ামের বাড়ি কুমিল্লার লালমাই উপজেলায়। রাকিবের বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার মুন্সিডাঙ্গা গ্রামে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাদের দুইজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনা শাহবাগ থানায় একটি জিডি হয়েছে।
ঘটনার সঙ্গে কোনো হত্যাকাণ্ডের সূত্র পাওয়া না গেলে অপমৃত্যু মামলা হতে পারে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।