পদ্মা সেতুর পিলারে একের পর এক ফেরির ধাক্কার পর মঙ্গলবার সকালে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, এবার সেতুর স্প্যানে ফেরির মাস্তুলের ধাক্কা লেগেছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সেতুর ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে ‘ওয়ান বি’ স্প্যানে ধাক্কা লেগে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নামের ফেরিটির মাস্তুল ভেঙে যায়। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজও প্রচার করা হয়।
তবে, ঘটনাটি সত্যি নয় বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তারা।
তারা জানান, সেতুতে ফেরির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের (মাস্তুলের) কোনো ধরনের স্পর্শ বা ধাক্কা লাগেনি। এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেতুর স্প্যানের স্পর্শ লাগার আগেই স্ট্যান্ডটি নুয়ে ফেলা হয়েছিল। একই বক্তব্য দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষও।
ফেরিটি মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে যাত্রা করে সেতুর মাওয়া প্রান্তে পৌঁছায় দুপুর ১২টার দিকে। সেতুতে কথিত ধাক্কার খবর শুনে সে সময় সেখানে উপস্থিত হন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ফেরি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্প্যানের সঙ্গে ফেরির ধাক্কার ঘটনা শুনে আমি নিজেই ছুটে এসেছি। আর্মি, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ থেকে ফেরি পরিদর্শন করা হয়েছে। তারা কোনো প্রকার আঘাত বা আঘাতের কোনো প্রকার প্রভাব রয়েছে এমন কিছু পায়নি। আঘাত লেগেছে বলে দেখানো হয়েছে, তবে আমি এটা বলতে পারি যে ওখানে কোনো ড্যামেজ হয়নি।’
মন্ত্রী ঘটনাস্থল থেকে চলে গেলে উপস্থিত সংবাদকর্মীর একটি দলকে সেনাবাহিনীর স্পিডবোটে করে নেয়া হয় সেতুর কিছুটা দূরে নোঙর করে রাখা সেই বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ফেরিতে।
সেখানে গিয়ে দেখা যায় ফেরির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডটি দড়ি দিয়ে বাঁধা। সংবাদকর্মীদের সামনে দড়ি টেনে সেটিকে নামানো হয়। পরে আবার ওঠানোও হয়।
ফেরিচালক ও উপস্থিত বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডটি আসলে ‘হাইড্রলিক’ যন্ত্র দিয়ে ওঠা-নামা করানো হয়। তবে, সেটি নষ্ট ছিল বলে দড়ি দিয়ে টেনে মাস্তুলটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল।
বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজে স্ট্যান্ডটির যে অংশ সেতুর স্প্যানে ধাক্কা দেয় বলে দেখা গেছে, সে অংশে কোনো দাগ বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিহ্ন দেখা যায়নি। তবে, স্ট্যান্ডের তিনটি সিগন্যাল বাতির মধ্যে একটি ভাঙা দেখা গেছে।
ফেরিচালক মো. রাসেল জানান, কিছুদিন আগে এই ফেরিটিই সেতুর পিলারে ধাক্কা দিয়েছিল। সে সময় একটি সিগন্যাল বাতি ভেঙে যায়। এরপর আর মেরামত করা হয়নি।
রাসেল সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘ফেরি থেকে স্প্যানের উচ্চতা অনেক... এটা (মাস্তুল) নামানো লাগে না। ফেরির দায়িত্বশীল লোক হিসেবে আমার মনে হইসে নিরাপত্তার জন্য এটা নামানো দরকার তাই নামায় দিসি। ফেরি পার হয়ে আবার উঠায় দিসি।’
টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দূর থেকে ভিডিও করাতে এমন মনে হতে পারে। আমরা দুইজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে দূর থেকে ভিডিও করলে মনে হতে পারে আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। এ রকম ভিডিও করায় মনে হইসে ওইটা কাছাকাছি। আসলে ওইটা ফেরিতে লাগেও নাই।’
এ সময় ফেরিতে উপস্থিত ছিলেন পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের এবং বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালবেলা এই ঘটনা আমরা দেখলাম, জাহাজ গেল, আবার ওখানে গিয়ে কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ভিডিওতে দেখছি (মাস্তুল) বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
‘বলা হচ্ছে ওটা (মাস্তুল) লোহার, লোহার হলে তো পড়ে যাবে, বেঁকে যাবে এবং ঘষা খাবে, কিন্তু ঘষার কোনো চিহ্ন নেই। এই সংবাদগুলো কেন আসছে, এটারও একটা তদন্ত হওয়া দরকার। আমার কথা ভুল হলে আমি খুশি হব যে, এটার মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র নেই।’
উচ্চতা অনুযায়ী স্প্যানে কোনো নৌযানের ধাক্কা লাগার কথা নয়- এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা তো আমাদেরও প্রশ্ন। পদ্মা সেতুর যে নকশা করা হয়েছে, সেই নকশা অনুযায়ী যে উচ্চতা থাকার কথা, সেখানে কোনোভাবেই ওপরের স্প্যানে আঘাত লাগার কথা নয়।
‘আজকে এটা হয়েছে, কেন হয়েছে? আমরা বলেছি, এটার নিবিড় তদন্ত করতে হবে। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত... এই ঘটনার পেছনে অন্য কিছু উদ্দেশ্য আছে কি না সেটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, আজকের ঘটনার মধ্যে আমি গভীর ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছি। এটার পেছনে কোনো...আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আমি বলেছি, সিনিয়র মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও আজকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা গভীরভাবে তদন্ত করতে হবে এবং এটা অবশ্যই উদঘাটন করতে হবে।’
গত ১৩ আগস্ট পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা লাগে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা কাকলি ফেরির। এতে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ওই পিলারেই ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় ধাক্কা লাগে ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের।
এর আগে ২৩ জুলাই সকাল ১০টার দিকে পদ্মা সেতুর ৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে রো রো ফেরি শাহ জালালের ধাক্কা লাগে। এতে ২০ যাত্রী আহত হন।
এসব ঘটনায় পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পদ্মা সেতুর পিলারের সুরক্ষায় স্রোতের তীব্রতা কমার আগ পর্যন্ত শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে যাত্রী ও মালবাহী ফেরি না চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর সুরক্ষায় প্রয়োজনে ফেরি চলাচলের রুট পরিবর্তন করা এবং পিলারগুলো প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে ফেলারও সুপারিশ এসেছে।