আট বছর হয়ে গেছে ঘরে ফেরেননি তেজগাঁওয়ের যুবদল নেতা সাজিদুল ইসলাম সুমন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগ থেকে যে আটজন উধাও হয়ে যান, তাদের একজন ছিলেন তিনি।
তখন বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলন চলছিল। এর মধ্যে এই অন্তর্ধান নিয়ে তখন বেশ আলোচনা হয়েছিল।
পরিবারগুলোর অভিযোগ, তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু র্যাব-পুলিশ তা কখনও স্বীকার করেনি।
সুমনের অন্তর্ধানের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে’।
দিবসটিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে ৩৪টি পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। এসব পরিবারের কারও ছেলে, কারও ভাই, কারও বাবা, কারও চাচার কোনো খোঁজ নেই সাত থেকে আট বছর ধরে। বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছিল বিএনপির আন্দোলন চলাকালে।
গুম প্রতিরোধ দিবসে প্রতি বছরই এরা জড়ো হন, কাঁদেন, স্বজনদেরকে উদ্ধার করতে সরকারের কাছে আকুতি জানান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাদের কান্নায় আপ্লুত হলেন সেখানে উপস্থিত আলোচক, শ্রোতারা।
স্বজনের অপেক্ষায় থাকা আরও অনেকগুলো পরিবারের সদস্য তাদের প্রিয় মানুষটির ছবি বুকে নিয়ে আলোচনা সভায় অংশ নেন।
আট বছর আগে উধাও হয়ে যাওয়া যুবদল নেতার মেয়ে হাফসা ইসলাম এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবার জন্য আকুতি ঝরে পড়ে তার বক্তব্যে।
হাফসা বলে, ‘আমার বাবা বেঁচে আছেন কি না জানি না। আমার বাবার জন্য আর এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদতে চাই না। আমরা এখন আর কাঁদতেও পারি না। চোখে পানি নেই। আমি শুধু বাবাকে ফিরে পেতে চাই।’
রাজধানীর সূত্রাপুরের ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিণ্টুও এভাবে উধাও হয়ে যান বছর সাতেক আগে। তার কোনো খোঁজই দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পিণ্টুার বোন রেহেনা আক্তার মুন্নি বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘ভাই গুম হওয়ার পর থেকে আমরা কোনো ঈদ করতে পারি না। আমাদের প্রত্যেকটা সকাল হয় অপেক্ষা নিয়ে। এই বুঝি একটা খবর পাব। কিন্তু দিন শেষে কিছুই হয় না। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে আমার ভাইয়ের সন্ধান ছাড়া আর কিছু চাই না।’
মুন্নি বলেন, ‘আমার ভাই ছাত্রদলের নেতা ছিল। ওর কী অপরাধ ছিল জানি না। অপরাধ করলে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিতে পারত। কিন্তু আজকে সাত বছরেরও বেশি সময় ভাইয়ের খোঁজ নেই। এত বছরে আমরা কোনও ঈদ করি নাই। ভাইয়ের জন্য কত জায়গায় গিয়েছি। ভাইকে পাইনি।’
তিনি জানান, ছেলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তার বাবা গত ২২ এপ্রিল হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাইকে ফিরে পেতে এখনো অপেক্ষা করছি। আপনাদেরও তো সন্তান আছে। তারা যে গুম হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? কেউ গুম হলে বুঝবেন কী যন্ত্রণা।’
মিরপুর এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেনের অপেক্ষায় আছেন তার মেয়ে আনিসা ইসলাম। বলেন, ‘বাবা বেঁচে আছেন কিনা তাও আমরা জানি না। বাবাকে ফিরে পেতে আর কত বছর লাগবে জানি না। আদৌ ফিরে পাব কি না, সেটাও বলতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই অনুরোধ, তিনি যেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন।
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও বক্তব্য দেন।
আলোচকরা গুমের জন্য সরকারের বিভিন্ন বাহিনীকে দায়ী করেন। তাদের অভিযোগ, সরকার এ বিষয়ে সব কিছুই জানে। একদিন গুমের জন্য সবার বিচার হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।