করোনা মহামারিতে চলাফেরার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর থেকেই কিশোরগঞ্জের হাওরে বাড়তে থাকে পর্যটকদের ভিড়। পর্যটনের ওপর থেকে বিধিনিষেধ সরে যাওয়ার পর রীতিমতো ঢল নেমেছে সেখানে।
নতুন বানানো অলওয়েদার সড়কই পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। সেই সঙ্গে ভিড় হাওরেও।
ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম– এ তিন উপজেলাকে যুক্ত করতে নির্মিত হয়েছে এই অলওয়েদার সড়ক।
প্রতিদিন এ সড়কে ঘোরাঘুরি শেষে পানিতে নেমে দাপাদাপি করেন দল বেঁধে আসা তরুণরা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাড়ে ভিড়।
বর্ষায় হাওরগুলো পানিতে টইটুম্বুর হওয়ায় বেড়েছে এলাকার সৌন্দর্য। অনেকে সারা দিনের জন্য বেড়াতে আসেন, অনেকে হাওরের আশপাশের হোটেল বা ডাকবাংলোগুলোতে রাত কাটান। ছুটির দিনে ওই তিন উপজেলার হোটেল-ডাকবাংলোগুলোতে ফাঁকা থাকে না কোনো কক্ষ।
ইটনা উপজেলার ডাকবাংলোর দায়িত্বে রয়েছেন মো. রাশেদ। তিনি বলেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিন ভিভিআইপিদের নিয়মিত বুকিং থাকায় সাধারণ পর্যটকদের বুকিং দেয়া সম্ভব হয় না।’
মিঠামইন ডাকবাংলোগুলোর দায়িত্বে থাকা মশিউর রহমান এবং অষ্টগ্রামের ডাকবাংলোর দায়িত্বে থাকা আইন উদ্দীনের সঙ্গেও কথা হয় নিউজবাংলার।
তারা জানান, সপ্তাহের পাঁচ দিন সাধারণ পর্যটকদের বুকিং নেয়া হয়। তবে ছুটির দিনগুলোতে বেশির ভাগই আসেন সরকারি বড় বড় কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে আগামি তিন সপ্তাহের জন্য সব ডাকবাংলো বুক হয়ে গেছে।
মিঠামইনে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামের একটি তিন তারকা মানের অভিজাত রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়নি। তার পরও সেখানে পর্যটকদের চাপে অগ্রিম বুকিং শুরু হয়েছে আরও দুই সপ্তাহ আগে থেকে। এরই মধ্যে আগামী মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত সব কক্ষ বুক হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম শাহরিয়ার।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে অনেকেই ভাড়া নিয়ে সমালোচনা করলেও সেবার মান এবং পরিবেশ দেখে চাপ বেড়েছে পর্যটকদের। রিসোর্টের অফিসিয়াল পেইজে দেয়া মোবাইল নম্বরে প্রতিদিনই বুকিংয়ের জন্য ফোন আসছে। কটেজ ফাঁকা না থাকায় বুকিং নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
খালি নেই তিন উপজেলার জেলা পরিষদের ডাকবাংলোগুলোও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকা থেকে আমাদের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা হাওর ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করে ফোন করেছেন। ওনারা আসতে চাইতেছেন। এক রাত থাকতে চান বলেও জানিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে। কোথাও কোনো ডাকবাংলো ফাঁকা পাচ্ছি না।’
পর্যটন সমাগম বাড়ায় খাবারের হোটেলগুলোতেও এখন বেচাকেনা জমজমাট। মিঠামইনের হ্যালিপ্যাড মাঠসংলগ্ন কাঁচালংকা হোটেলে শনিবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, একটি টেবিলও ফাঁকা নেই। বাইরেও অপেক্ষায় আছেন ক্রেতারা।
হোটেলের ভেতরে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন মানিকগঞ্জের তরুণ সাইফুল ইসলাম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুই পাশে পানি আর মাঝখান দিয়ে রাস্তার দৃশ্য ফেসবুকে দেখে এখানে এসে মোটরসাইকেল চালানোর লোভ সামলাতে পারি নাই। ভোর ৫টায় বাড়ি থেকে রওনা হয়ে ১০ বন্ধু মিলে মোটরসাইকেল নিয়ে আসছি।
‘এখন লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠার মতো এই হোটেলে ঢুকে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি।’
হোটেল কাঁচালংকার পরিচালক মো. আলমগীর জানান, ‘সপ্তাহের পাঁচ দিন তেমন ভিড় না থাকলেও শুক্র, শনিবারটা কাটে অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। এমনও হয়, অনেকে বসার জায়গা না পেয়ে ফিরে যান।’
অলওয়েদার সড়ককে ঘিরে পর্যটক বাড়ায় কর্মসংস্থানও হয়েছে অনেকের। পর্যটকদের এলাকা ঘুরে দেখাতে কেউ ভাড়ায় চালাচ্ছেন মোটরসাইকেল, নৌকা, স্পিডবোট ও অটোরিকশা, কেউ ছুটছেন ঘোড়া নিয়ে।
ইটনা উপজেলার পূর্বগ্রামের অটোরিকশাচালক জিলু মিয়া বলেন, ‘এই রাস্তাডা অওয়ার আগে বাইস্যে মাসো বেকার আছলাম। আর অহন বাইস্যে মায়া দিনেও অটোরিকশা চালাইয়া হাজার খানেক টেহা রুজি করতাম ফারি। আল্লাহ রাষ্ট্রপতিরে বাঁচাইয়া রাহুক।’
মিঠামইন সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ কামাল জানান, হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে প্রতিটি অটোরিকশায় ভাড়ার তালিকা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ সড়কটির নির্মাণকাজ ২০১৬ সালে ২১ এপ্রিল উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সড়কটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।