গত বছরের মতো এবারও রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হলো।
করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তার ঠেকাতে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সারা দেশে ১৮ দিন ‘কঠোর লকডাউন’ চলে। ওই সময়ে বাংলাদেশ মূলত অচল ছিল। তারই প্রভাব পড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়ে; তলানিতে ঠেকেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৩ হাজার ৮৩৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১ হাজার ৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসেই লক্ষ্যের চেয়ে ৭ হাজার ২২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে।
গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সবমিলিয়ে ১৪ হাজার ৭৫৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাসও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। লক্ষ্যের চেয়ে রাজস্ব আদায় কমছিল ৭ হাজার ৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে অর্থবছর শেষ হয় ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এই মাসে এ খাত থেকে ৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরেছিল এনবিআর; আদায় হয়েছে ৪ হাজার ২৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গত বছরের জুলাই মাসে আদায় হয়েছিল ৫ হাজার ৬২০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এ হিসাবে জুলাই মাসে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ভ্যাট থেকে সরকারের কোষাগারে ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ কম জমা পড়েছে।
আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক বাবদ রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। জুলাইয়ে এ খাত থেকে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৮৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে আদায় হয়েছিল ৫ হাজার ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা।
তবে, এই সঙ্কটকালেও আয়কর আদায়ে বড় সাফল্য দেখিয়েছে এনিআর; আদায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। জুলাইয়ে আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৪ হাজার ৭৩২ কোটি ৯ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। গত বছরের একই মাসে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৯২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই মাস তো প্রায় অচলই ছিল। অর্ধেকেরও বেশি সময় কঠোর লকডাউন ছিল। কোনো ধরনের উৎপাদন কার্যক্রম চলেনি। দোকানপাট-হাটবাজার বন্ধ ছিল। পোশাক কারখানাও বন্ধ ছিল বেশ কয়েক দিন। সবমিলিয়ে ওই মাসে রাজস্ব কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। আয়কর খাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটাই অবাক লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন তো মহামারির মধ্যেও সবকিছু চলছে। করোনার টিকাদান কার্যক্রম চলছে। মানুষের মধ্যে সাহস সঞ্চার হয়েছে। সবাই ধরে নিয়েছে, করোনার সাথে যুদ্ধ করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে সবাই যে যার মতো করে কাজ করছে। আমার ধারণা, আগামী মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফটসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত হয়ে ভ্যাট দিতে শুরু করেছে। তার একটা ইতিবাচক প্রভাব সার্বিক রাজস্ব আদায়ে পড়বে।’
বড় ধরনের কোনো সংকট না আসলে গত অর্থবছরের মতো এবারও রাজস্ব আদায়ে মোটামুটি একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হবে বলে আশার কথা শোনান আহসান মনসুর।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ রাজস্ব আদায় বাড়াতে ব্যাপক সংস্কারের উপর জোর দিচ্ছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর এই কঠিন পরিস্থিতিতে যে সব খাত ভালো করছে, তাদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করতে হবে; আর যারা খারাপ করছে তাদের ছাড় দিতে হবে।’
২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ভ্যাট থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি এবং আমদানি ও রপ্তানি কর থেকে ৯৬ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।