বাংলাদেশে নারী কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি অবদান রংপুর বিভাগে। কর্মজীবী নারীর মধ্যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৮ জনেই এই বিভাগের।
অন্যদিকে সবচেয়ে কম অবদান ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগে। কর্মজীবী নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮ শতাংশ করে এই দুই বিভাগের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের যৌথভাবে এই গবেষণাটি চালিয়েছে। রোববার গবেষণাটির ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সামগ্রিক দৃশ্যমান মূল্যায়ন ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং জিডিপির মধ্যে সম্পর্কের পরিমাপের লক্ষ্যে এই গবেষণাটি করা হয়।
বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সাতক্ষীরা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও সুনামগঞ্জের ৮৫০টি খানা ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের উপর জরিপ চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে আসে তারা।
প্রতিবেদন বলছে, যদি এই হার কেবল ১ শতাংশ বাড়ানো যায়, তাহলে প্রবৃদ্ধিতে যোগ হয় শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ। যদি ১০ শতাংশ হয়, তাহলে জিডিপি বাড়বে ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ২২.৯৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণকারী, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ২০ শতাংশ নারী যারা কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি।
পেশাগত দিক থেকে নারীদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ দেখা যায় কৃষি, মৎস্য ও বনজ খাতে ৫৩.৮ শতাংশ, প্রাথমিক পেশায় আছেন ৪০.৬ শতাংশ নারী এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কেবল ১১.৩ শতাংশ নারী কর্মরত আছেন।
নারী কর্মসংস্থান বাড়লে বাড়বে জিডিপি
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে নারীর কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২১ সালের জিডিপির তথ্য বিবেচনা করলে কেবল ১০ শতাংশ নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে যোগ করতে পারত বাড়তি ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
তবে স্বল্প সময়কালে জিডিপি ও নারী বা পুরুষের কর্মসংস্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক নেই বলে জরিপের ফলাফল সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ দেশের অন্যতম বড় দাতা ও এডভোকেসি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকদিন ধরে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করে আসছে। নারীর ক্ষমতায়নের উপর ওয়ার্ল্ড ভিশনের তিনটি প্রকল্প রয়েছে- নবযাত্রা, এনএসবিসি ও আল্ট্রা পুর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম (ইউপিজি)।
এই গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ওয়ার্ল্ড ভিশনের এই ৩টি প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সামগ্রিক দৃশ্যপট মূল্যায়ন করা, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং জিডিপির মধ্যে সম্পর্কের পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য নীতিগত সুপারিশ নির্ধারণ করা।
জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ৬১.৮ শতাংশ নারী সরাসরি প্রকল্পগুলোর সদস্য, ১৪.৩৩ শতাংশ নারীর সুবিধাভোগকারীর পরিবারের সদস্য এবং ২৩.৮৮ শতাংশ নারী কোনো প্রকল্পের সদস্য নন।
জরিপে প্রকল্পের সুবিধাভোগী এবং সুবিধা ভোগ করেন না-এরকম পরিবারের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে, ১৫-৪৯ বছর বয়সী পুরুষদের ৮১.৯ শতাংশ উপার্জন করলেও মাত্র ৩৪.৪ শতাংশ নারী একই কাজ করে।
উপার্জনকারী, সুবিধাভোগী এবং সুবিধা ভোগ করেন না এরকম নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৪৪.০১ শতাংশ এবং ৩৪.৮৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে মজুরি কর্মসংস্থানের আওতায় ৪২.৬ শতাংশ পুরুষের বিপরীতে রয়েছেন ৩১.২ শতাংশ নারী, আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ৫২.৫ শতাংশ পুরুষের বিপরীতে রয়েছে ৩৯.২ শতাংশ নারী।
অবৈতনিক শ্রমের দিক থেকে নারী-পুরুষের মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান। কেবল ৪.২ শতাংশ পুরুষের বিপরীতে দেশের প্রায় ২৯.১ শতাংশ নারী অবৈতনিক শ্রমের আওতাধীন।
পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শহরে নারী প্রধান পরিবার রয়েছে ১২.১২ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১০.৩২ শতাংশ। প্রায় ১০.৯৪ শতাংশ পরিবারে নারী মূল সিদ্ধান্তকারী, স্বামী কিংবা শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ায় থাকেন ৩৯.৩১ শতাংশ নারী, ২০.৩ শতাংশ পরিবারে নারী কোন সিদ্ধান্ত দেন না এবং ২৮.১৮ শতাংশ পরিবারে সকল সদস্যের গ্রহণের সুযোগ আছে।
জরিপে প্রকল্পের সদস্য এবং যারা সদস্য নন তাদের মধ্যে বিভিন্ন সূচকে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ৬৩.৭ শতাংশ কর্মজীবী প্রকল্পের সদস্য নারী তার আয়ের কিছু অংশ সঞ্চয় করেন এবং ৪২.৯ শতাংশ সুবিধা না পাওয়া নারী সঞ্চয় করে থাকেন।
৬৪.১ শতাংশ প্রকল্পের সদস্য নারীর মোবাইল ব্যাংকিং এর ধারণা রয়েছে; অন্যদিকে প্রকল্পের সদস্য নয় এরকম নারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং এর ধারণা রাখেন।
নারী উন্নয়ন ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়
জরিপের ফলাফর প্রকাশ উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
ওয়েবিনারের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা ও সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট মাহতাব উদ্দিন।
প্রবন্ধের উপর ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ পরিচালক চন্দন গোমেজ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) নাসিমা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা আক্তার, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক সুরেশ বার্টলেট আলোচনা করেন।
সায়মা হক বিদিশা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব নয়। আর সেক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ছাড়া কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। ২০১৮-১৮ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম।
‘করোনার আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ হবে বলে হিসাব দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।’
‘করোনা কেটে গেলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়তেই হবে,’ বলেন বিদিশা।