পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে উৎপাদন চালুর তথ্য গোপন করে এর পরিচালকদের কম দামে শেয়ার কেনার সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কোম্পানিটি বস্ত্র খাতের তাল্লু স্পিনিং। ২০২০ সালের ৩১ মে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জকে দেয়া নোটিশে তারা জানায়, ওই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে কারখানা বন্ধ। আর করোনার পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেটি আবার চালু হবে।
এরপর কোম্পানির তিনজন পরিচালক গত এক বছরে মোট ৪ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার কিনেছেন বাজার থেকে।
১৫ মাস পরে এসে রোববার এই কোম্পানিটি আবার ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়, ২০২০ সালের ৬ মে থেকে কারখানা চালু আছে। অথচ এর ২৫ দিন পর কারখানা বন্ধের সেই নোটিশটি এসেছিল।
আবার কারখানা গত বছরের ৬ মে থেকে যে চালু, সেটি গত ১৫ জুলাইও কোম্পানির পক্ষ থেকে দেয়া জবাবে জানানো হয়নি।
কারখানার উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদর ২ টাকা ৭০ পয়সায় নেমে গিয়েছিল। আর সম্প্রতি হঠাৎ করেই টানা বাড়তে বাড়তে তা প্রায় ১৩ টাকা হয়ে যায়।
বন্ধ একটি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এত হুলুস্থুল হয়ে হওয়ার কী কারণ, এ নিয়ে দুবার তাল্লুকে নোটিশ করে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। তার জবাবেও কোম্পানির উৎপাদন চালুর বিষয়ে তথ্য না জানিয়ে বলা হয়, তাদের পক্ষে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
রোববারের নোটিশে যে প্রশ্ন
২০২০ সালের ৩১ মে তাল্লু কর্তৃপক্ষ ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে নোটিশ দেয়। জানানো হয়, ৭ এপ্রিল কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে।
এই সিদ্ধান্ত জানানোর সময় পুঁজিবাজারে লেনদেন স্থগিত ছিল। জুলাইয়ে লেনদেন আবার চালু হলে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২ টাকা ৭০ পয়সায় নেমে আসে।
প্রায় এক বছরে সেখান থেকে শেয়ারমূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়। গত ৫ মে দাম ছিল ৪ টাকা। সেখান থেকে হঠাৎ করেই দামে উল্লম্ফন হয়।
বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদর তড়তড় করে কেন বাড়ছে, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ তাল্লুকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয় গত ১৪ জুলাই।
২০২০ সালের ৩১ মের সেই নোটিশ, যাতে জানানো হয়, ওই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ
এই নোটিশের জবাবে পরদিন তাল্লু জানায়, তাদের কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
এই নোটিশ দেয়ার আগে ৯ কর্মদিবসের মধ্যে ৭ কর্মদিবসই বেড়েছে কোম্পানিটির শেয়ার দর। একটি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদর এভাবে বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না, সে প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে।
গত ২৭ জুন দাম বৃদ্ধি শুরুর দিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর নোটিশ দেয়ার দিন মূল্য ছিল ৭ টাকা ৯০ পয়সা।
তৃতীয় দফায় মূল্য উল্লম্ফন শুরু হয় ৩ আগস্ট থেকে। ৬ কর্মদিবসে ৭ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬০ পয়সা হয়ে যায়, দাম বাড়ে ৫৯ শতাংশ।
এই কোম্পানির হঠাৎ কী হলো, এমন প্রশ্নে ২২ আগস্ট আবার তাল্লুকে নোটিশ দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ।
এই নোটিশের জবাব আসে এক সপ্তাহ পর।
রোববার লেনদেন শুরু হওয়ার আগে আগে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে বিনিয়োগকারীদের জন্য তাল্লুর জবাবটি পোস্ট করা হয়।
এতে বলা হয়, ২০২০ সালের ৬ মে থেকে তাল্লুর কারখানা চালু আছে, যেটি লকডাউনের কারণে ১৪ এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
তাল্লুর যে যুক্তি
পুঁজিবাজারে কোম্পানির যেকোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করতে কোম্পানি বাধ্য। অথচ কোম্পানি বন্ধ করার তথ্য দিলেও কোম্পানি চালু করার বিষয়টি গোপন রাখা, ১৫ মাস পর সেটি জানানোর বিষয়ে প্রশ্নে তাল্লুর কোম্পানি সচিব মমিনুর রহমান দেন আরেক ধরনের ব্যাখ্যা।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি পুরোদমে কখনও বন্ধ ছিল না। করোনার কারণে কোম্পানির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ ছিল। যেহেতু সেটি বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তাই সেটি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা পরবর্তী সময়ে আবার চালু করা হয়েছে ৬ মে ২০২০।’
কোম্পানির উৎপাদন চালু করে গোপন রাখা হলো কি না- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রেখেছিলাম এবং সে সময়ই নোটিশে বলে দেয়া হয়েছিল, সরকারের লকডাউনের সময়সীমা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। ফলে সরকার যখন লকডাউন তুলে নিল, তখন আমরা উৎপাদন চালু করেছি। ফলে এটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের মধ্যে পড়বে না।’
রোববারের নোটিশ, যাতে বলা হয়েছে ২০২০ সালের ৬ মে থেকে উৎপাদন চালু। এটি আবার গত ১৫ জুলাইয়ের নোটিশে জানানো হয়নি
তাহলে এখন কেন জানালেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম নোটিশে সবকিছু স্পষ্ট করে বলে দেয়া হলেও বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ, সেটিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই আমাদের কাছে ফোন করে জানতে চান, কোম্পানি চালু হয়েছে কি না। কিন্ত আমাদের কোম্পানি তো বর্তমানে চালু আছে।
‘বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নের বিষয়টি বিএসইসি ও ডিএসইকে জানানোর পর আমাদের একটি নোটিশ করে দিতে বলেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই নোটিশ করা হয়েছে।'
তিনি আবারও বলেন, 'এটি কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নয়।’
কোম্পানি সচিব এ কথা বললেও গত ১৪ জুলাই ডিএসইর আগের নোটিশের পর কেন জানানো হয়নি- এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য তার কাছে পাওয়া যায়নি।
‘এই জবাব গ্রহণযোগ্য নয়’
তাল্লুর কোম্পানি সচিবের এই ব্যাখ্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণাপ্রধান দেবব্রত কুমার সরকার।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রাখা যেতে পারে। কারণ সে সময় সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সমন্বয় করেই সবকিছু পরিচালিত হয়ে আসছিল। শুধু তাল্লু নয়, সব কোম্পানির উৎপাদন সে সময় ব্যাহত হয়েছিল। যেহেতু কোম্পানিটি উৎপাদন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল, সেহেতু চালু করার মাত্রই তাদের উচিত ছিল আগের নোটিশের ধারাবাহিকতায় আরও একটি নোটিশ করার।’
তিনি বলেন, ‘এতে বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। বিষয়টি তথ্য গোপনের পর্যায়েও পড়ে।’
উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর তাল্লুর শেয়ারদর ২ টাকা ৭০ পয়সায় নেমে আসে। সম্প্রতি তা সর্বোচ্চ ১২ টাকা ৮০ পয়সায় ওঠে
টানা চার বছর লোকসান দেয়া কোম্পানিটি ১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপর সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল শেয়ারধারীদের। এ ছাড়া ২০১২ সালে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পনিটি মূলধন সংগ্রহ করেছিল।
তাল্লু সবশেষ লভ্যাংশ দিয়েছিল ২০১৫ সালে। ওই বছর বিনিয়োগকারীরা ১০ শতাংশ বোনাস, অর্থাৎ প্রতি ১০টি শেয়ারে একটি পেয়েছিলেন লভ্যাংশ হিসেবে।
ডিএসই-বিএসইসি কী বলছে
তাল্লুর এই কাজের বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। তবে অফিসে যাওয়ার পর বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।’
ডিএসইর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘এটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের মধ্যেই পড়ে। তবে কোম্পানি কেন বিষয়টিকে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বলছে না, সেটি দেখতে হবে।’
বন্ধ থাকার সংবাদ আসার পর পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়
কোম্পানির উৎপাদন চালু- এই বিষয়টি যখন জানা ছিল না, সে সময় তাল্লুর পরিচালক আতিকুল হক গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এই শেয়ার কেনা হবে বলে জানানো হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জানানো হয় আতিকুল তার শেয়ার কেনা শেষ করেছেন।
উৎপাদন বন্ধ থাকার ঘোষণা দেয়ার পর তাল্লুর তিন পরিচালক কিনেছেন ৪ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার
শেয়ার কেনার ঘোষণা দেয়ার দিন দাম ছিল ৪ টাকা ৮০ পয়সা আর কেনা শেষ করার কথা জানানোর দিন দাম ছিল ৪ টাকা ১০ পয়সা। এই সময়টায় দাম সর্বোচ্চ ছিল ৫ টাকা ৬০ পয়সা।
আরেক পরিচালক রাবেয়া খাতুনের ১০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা আসে ১০ ডিসেম্বর। তিনি এই শেয়ার কিনে শেষ করেছেন বলে ঘোষণা আসে ৮ ফেব্রুয়ারি।
তৃতীয় যে পরিচালক শেয়ার কিনেছেন, তিনি হলেন রফিকুল হক। তিনি গত ১০ ডিসেম্বর ২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। তিনিও গত ৮ ফেব্রুয়ারি শেয়ার কেনা শেষ করার তথ্য জানান।
সেদিন থেকে শেয়ারের দর বেড়েছে ৭ টাকা বা ১৭০ শতাংশ।