‘২৫ বৎসর হয়া (হয়ে) আচ্চে কোনোটি ডাক্তারক (ডাক্তার) দ্যাখাইনি। চরোত (চরে) ক্যাম্প করিচ্চে শুন্যা (শুনে) হামাক (আমাকে) সিলিপ করা দিছে ছোল (ছেলে)। আইজ বিয়ানে (সকালে) অসুদ (ওষুধ) নিবার আচ্চি বাবা।’
কথাগুলো বলছিলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের মানিকদাইর চরের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী সাবিনা ইয়াসমিন।
জন্মের পর থেকে তিনি কোনো চিকিৎসককের কাছে যাননি। অসুস্থ বোধ করলে ওষুধ এনেছেন স্থানীয় ফার্মেসি থেকে। প্রথমবারের মতো তার চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ হয় শনিবার।
গতকাল চরে চিকিৎসক আসার খবর পেয়ে দাঁতের সমস্যা নিয়ে সাবিনা যান মেডিক্যাল ক্যাম্পে। তাদের কাছে সেবা পেয়ে খুশি এ নারী।
শুধু সাবিনা নন, তার মতো অনেকেই প্রথমবার চিকিৎসক দেখাতে পেরেছেন চরে কার্যক্রম শুরু করা বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়ে। এ ক্যাম্পের কার্যক্রম চলবে এক সপ্তাহ। তারপর নিয়মিত বিরতিতে চরে যাবেন চিকিৎসকরা।
চরের বাসিন্দা বৃদ্ধ তাজেম আলী। সর্বশেষ চিকিৎসাসেবা নিতে দুই বছর আগে সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন। বার্ধক্যজতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তিনি; রয়েছে শ্বাসকষ্টও।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত যাতায়াতে তার খরচ হয় ৩০০ টাকার মতো। এই টাকা খরচ করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
চরে চিকিৎসক আসার খবর পেয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্পে যান তিনি।
তিনি বলেন, ‘ডাক্তারের প্রেসকিপশন আর ওষুধ পেইয়ে অনেক খুশি হামি। টাকার অভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেইতে পারিনি দুই বছর ধরে।’
মানিকদাইর চরের বাসিন্দা রুপালি বেগম। তিনি মেডিক্যাল ক্যাম্পে আসেন তার পাঁচ বছরের মেয়ে মরিয়মকে ডাক্তার দেখাতে।
তিনি বলেন, ‘মরিয়মক জন্মের পর থেইকে কখনো ডাক্তার দেখাইনি। ডাক্তার আসার খবর পেইয়ে মেয়েকে নিয়ে আসছি।’
একই চরের আব্দুর রহিম দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন চোখের সমস্যায়। তিন বছর আগে বগুড়া শহরে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন, এরপর আর কোনো চিকিৎসকের কাছে যাননি। জেলা শহরে বারবার যাতায়াত করার মতো টাকা তার কাছে নেই। তিনিও গ্রাম থিয়েটারের সেবা কেন্দ্রে আসেন।
মানিকদাইর চর এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদার মান্নান। ওই সময় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না।
প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সামির হোসেন মিশু। বিশেষ অতিথি ছিলেন সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান মতি, জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মেয়র হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ থিয়েটারের আন্তর্জাতিক সম্পাদক আব্দুল হান্নান, সংগঠনের সমন্বয়কারী (পুন্ড্র অঞ্চল, বগুড়া-জয়পুরহাট) শাহাজাদ আলী বাদশা, সারিয়াকান্দি চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলীসহ অনেকে।
সেবাকেন্দ্রের উদ্বোধনের প্রথম দিনেই উপজেলার চর চালুয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্প বসিয়ে তিন শতাধিক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। সেবাগ্রহীতাদের দেয়া হয়েছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও প্রয়োজনীয় ওষুধ।
এই মেডিক্যাল ক্যাম্পটি পরিচালনা করে পুন্ড্র অঞ্চল, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার (বগুড়া-জয়পুরহাট)।
প্রথম দিনের মেডিক্যাল ক্যাম্পে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১২ জন চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। এতে নেতৃত্ব দেন চিকিৎসক সামির হোসেন মিশু।
গ্রাম থিয়েটার সূত্রে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে তারা সারিয়াকান্দি উপজেলার মানিকদাইর চর এলাকায় সেবাকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করেছে। পরে ধুনট উপজেলার বৈশাখী চরে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এ সংগঠন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করবে।
এই সেবাকেন্দ্রে ছয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকবে। যেকোনো জরুরি রোগীর প্রয়োজনে এগুলো ব্যবহার করা হবে।
শুধু বগুড়াতেই নয়, সারা দেশে আরও ২৬৫টি কেন্দ্র স্থাপন করে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে এই সংগঠন। সেবাকেন্দ্র সামনে আরও বাড়ানো হবে বলেও জানা গেছে।
মানিকদাইর চর এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। ২০১৪ সালে সেখানকার একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার পর নতুন করে আর তৈরি করা হয়নি। এমন বাস্তবতায় গ্রাম থিয়েটারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা পেয়ে স্বস্তির ছাপ দেখা যায় তাদের মুখে।