স্কুল গেছে নদীর পেটে। স্কুলের মালপত্র পড়ে আছে খোলা জায়গায়। আশপাশে আর কোনো স্কুলও নেই, যেখানে পড়ালেখা করবে স্থানীয় শিশুরা।
এই চিত্র শুধু একটি স্কুলের না। কুড়িগ্রামের চার উপজেলার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই অবস্থা।
স্কুলগুলো হলো উলিপুর উপজেলার পশ্চিম বজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চেরাগের আলগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুলা কুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাগেশ্বরী উপজেলার আকবর আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশাম বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রৌমারী উপজেলার ফলুয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘুঘুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এগুলো তলিয়েছে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদ-নদীর পানিতে।
যদিও শিক্ষা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বিলীন হওয়া স্কুলের সংখ্যা পাঁচটি।
কুড়িগ্রাম জেলায় ১৬টি নদ-নদী আছে। বর্ষা মৌসুমে এ বছর এই জেলায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও নদীভাঙনে বিপাকে পড়েছে এলাকার মানুষ। স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি আর ফসলি জমির পাশাপাশি নদীগর্ভে হারাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। এতে শিশু-কিশোরদের পড়ালেখা নিয়ে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা।
জেলার সাতটি উপজেলার আরও ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে আছে ভূরুঙ্গামারীর ১১টি, রাজিবপুরের ৩টি, উলিপুরের ২টি, সদর, নাগেশ্বরী, রাজারহাটের একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; উলিপুরের ১টি মাদ্রাসা ও ১টি উচ্চ বিদ্যালয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষায় জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে হলেও এগুলো ভাঙন থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
ভূরুঙ্গামারী ২ নম্বর পাইকেরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুধকুমার নদীর দূরত্ব এখন ২০ ফুট।
ওই এলাকার জলিল মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই স্কুল ভাইঙ্গা গেলে হামার সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার যদি দ্রুত ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয়, তাইলে গ্রামও ডুবব।’
বুলবুলি আক্তার বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি, হামার স্কুল আর গ্রাম রক্ষার জন্য বোল্ডার দিয়া একটা বাঁধ করে দিক সরকার।’
নাগেশ্বরী উপজেলার রঘুরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়স ১১৮ বছর। প্রাচীন এই স্কুল থেকে গঙ্গাধর নদ এখন ৫০ মিটার দূরে।
এই স্কুলের সাবেক ছাত্র মজিবর রহমান বলেন, ’৫০ বছর আগে এই স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করেছি। আমার সন্তান এখন এখানে পড়ে। আশপাশে আর কোনো স্কুল নেই। এটা নদীতে তলিয়ে গেলে আমার ছেলে পড়বে কোথায়?’
রাজহারহাটের গতিয়াশাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কয়েক দিন আগে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। আসবাবগুলো আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছে কিছুদূরের খোলা জায়গায়।
এই এলাকার রেশমা আক্তার বলেন, ‘স্কুল ভাঙ্গি গেইল। এলা ছোয়াপোয়ার কী হবে? হামার তাও এটি-ওটি এদন করি চলবে, কিন্তু আর ছোয়ার পড়ালেখার কী হবে?’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক লস্কর আলী জানান, নতুন করে স্কুল নির্মাণের জায়গা পাওয়া না গেলে অনেক শিশু পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়বে।
নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাস ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকমল হোসেন জানান, করোনা মহামারিতে এমনিতেই শিশুরা বহুদিন ধরে পড়ালেখা থেকে দূরে। এখন স্কুলের এই অবস্থা হলে তাদের আর পড়ালেখা হবে না। অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, সরকারি হিসাব অনুযায়ী পাঁচটি স্কুল বিলীন হয়েছে, হুমকিতে আছে ১৬টি। বিলীন হওয়া স্কুলগুলো পুননির্মাণের জন্য স্থানীয়ভাবে জায়গা নির্ধারণের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি ভাঙনের আশঙ্কায় থাকা স্কুলগুলো রক্ষার জন্য জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
তবে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলম বলেন, ‘চলতি বন্যায় এখন পর্যন্ত কোনো মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা বিলীন হয়নি। এগুলো ভাঙনের ঝুঁকিতেও নেই।’