দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে চালু হতে যাচ্ছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরেই হবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়ে। রানওয়ের একটি অংশ তৈরি করা হচ্ছে সমুদ্র ভরাট করে। ফলে এক প্রকার সমুদ্র ছুঁয়ে এখানে রানওয়েতে বিমান ওঠানামা করবে।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র বলছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ঘিরে তৈরি হবে এভিয়েশনের হাব। সারা বিশ্ব থেকে সুপরিসর বিমান কক্সবাজারে ওঠানামা করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পেয়ে বাসিন্দারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
২৯ আগস্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যেভাবে তৈরি হবে সমুদ্রে রানওয়ে
বেবিচক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯ হাজার ফুট দীর্ঘ রানওয়েকে ১০ হাজার ৭০০ ফুটে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ ফুট থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করতে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ব্লক দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে রানওয়ে।
প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেবিচক। এই নির্মাণকাজের দায়িত্ব পেয়েছে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান।
৫ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও শক্তি বৃদ্ধি, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলমান।
সাগরের মধ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ করতে প্রথমে সাগরের নিচে স্থাপন করা হবে জিও টিউব, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করা হবে পানি। শুরু হবে খনন-প্রক্রিয়া ও বালু ভরাট কার্যক্রম।
এরপর প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে হবে বালুর স্তরবিন্যাস। চূড়ান্ত পর্যায়ে হবে রানওয়ের জন্য বালুর স্তরবিন্যাস। তারপর হবে পাথুরে স্তরবিন্যাস ও নিশ্ছিদ্রকরণ, পিচঢালাই ও নিশ্ছিদ্রকরণ। এভাবেই তৈরি হবে রানওয়ে ও প্রাথমিক সমুদ্র থেকে রক্ষাকারী বাঁধ। এর পরপরই হবে রানওয়ের শোভাবর্ধন ও নির্দেশক বাতি স্থাপন।
সমুদ্র তলদেশে ব্লক তৈরি করে এর ওপর স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। দেশে এই প্রথম কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়।
নামবে বোয়িং
কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বিমানবন্দরের মহেশখালী চ্যানেলের দিকে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হচ্ছে এই রানওয়ে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠানামা করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় খুশির শেষ নেই কক্সবাজারবাসীর।
পিএমখালীর প্রবাসী মিজানুর রহমান বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ওমান পাড়ি দিয়েছিলাম। ফিরেছি করোনার আগেই। সামনে আবারো সৌদি আরব যাচ্ছি। আগে আমাদের অন্যান্য দেশে যেতে হলে হয় চিটাগাং, নয় তো ঢাকা এয়ারপোর্টে যেতে হতো। এখন কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় আমার শহর থেকে সরাসরি প্রবাসে যেতে পারব। এটা হবে তা কখনও কল্পনাও করিনি।’
নুনিয়ারছড়া এলাকায় বাসিন্দা নুরুল আজিম রানা বলেন, ‘বাড়ির সামনে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সত্যি স্বপ্নের মতো লাগছে। আগে প্রবাস থেকে কোনো আত্মীয় দেশে এলে চিটাগাং গিয়ে রিসিভ করতে হতো। কিন্তু এখন ঘরের সামনে এসে পড়বে বিমান। খুব ভালো লাগছে।’
কক্সবাজারের বাসিন্দা বর্তমানে সৌদিপ্রবাসী শওকত আলী বলেন, ‘১০ বছর ধরে প্রবাসে আছি। যখনই দেশে ফিরি তখন চিটাগাং থেকে আবারও কক্সবাজার দীর্ঘপথ সড়কে পাড়ি দিতে হতো। এখন সোজা কক্সবাজার খুব ভালো লাগছে।’
আশপাশের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবেন স্থানীয়রা।
প্রশাসন যা বলছে
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রানওয়ে। বড় বড় বোয়িং ও বিশ্বের বড় বিমানগুলোও এই রানওয়েতে নামতে পারবে।
আগামী বছরই কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে যাত্রা শুরু করবে বলে তিনি আশা করছেন।
২৯ আগস্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্প্রসারণকাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই রানওয়ে সম্প্রসারণকে ঘিরে নানা রঙে সেজেছে কক্সবাজার শহর। মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে এলইডি স্ক্রিন, যাতে দেখানো হবে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান। ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো শহর।
২৭ আগস্ট বিকেলে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখতে যান বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান।
এ সময় তিনি বলেন, ‘প্রথমে ৯ হাজার ফুট থেকে আরও ৩ হাজার ফুট সমুদ্রে রানওয়ে সম্প্রসারণের কথা ছিল। কিন্তু অনেক গবেষণা ও কক্সবাজারের পরিবেশের কথা চিন্তা করে রানওয়ে ১ হাজার ৭০০ ফুট সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এটি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। রানওয়ে সম্প্রসারিত হলে দেশের পর্যটনসহ অর্থ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এ ছাড়া এই বিমানবন্দরকে ঘিরে একটি এভিয়েশন হাব তৈরি হবে।’
বেবিচকের চেয়ারম্যান মফিদুর আরও বলেন, ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণকাজ শেষ হলেই এখানে ওঠানামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর এয়ারবাস।’
প্রস্তুতি দেখতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীও যান।
এ সময় তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলমান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিমানবন্দরের উন্নয়ন।
‘আশা করছি, গোটা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজারে সহজে যাতায়াতসহ নানাবিধ সুবিধা ভোগ করবেন।’