পুরান ঢাকার রায়সাহেব মোড় থেকে জনসন রোড ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিকে এগোলেই রাস্তার পশ্চিম পাশে বিউটি লাচ্ছি ও ফালুদার দোকান। যুগ যুগ ধরে মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি। একশ বছর পূর্ণ হতে যাওয়া বিউটি লাচ্ছি এখনও তার স্বাদের সুনাম ধরে রেখেছে। একই সঙ্গে পরিণত হয়েছে ঢাকাবাসীর অন্যতম ঐতিহ্যে।
১৯২২ সালের ১৫ জুন ফুটপাতে লেবুর শরবত ও লাচ্ছি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আব্দুল আজিজ। ষাটের দশকে এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের আব্দুল গাফফার মিয়ার সময়ে দোকানটি বিউটি লাচ্ছি হিসেবে পরিচিতি পায়। এখন লাচ্ছির পাশপাশি ফালুদাও বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকার ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে বিউটি লাচ্ছি-ফালুদা। শতবর্ষ ছুঁতে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার খাবারের ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করেছে।
৩৫ বছর ধরে বিউটি লাচ্ছি-ফালুদা দোকানের মালিক জাবিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিউটি নামটি আসলে শরবতের সৌন্দর্যকে ছড়িয়ে দেয়া জন্যই দেয়া হয়েছিল। সৌন্দর্য থেকেই এই নাম। সত্যি কথা বলতে কি তখন তো কোনো দোকানপাট ছিলো না আশপাশে।
‘কেউ যদি আসত তাহলে বিউটি লাচ্ছিই বলত। সেই থেকেই আসলে এই নামকরণ হয়েছিল। আর এই রাস্তাটা তো আরও অনেক ছোট ছিল, এটি আস্তে আস্তে যখন বড় হয়, তখন আমাদের দোকানটি বেড়ার ঘরে আসে৷ তারপর এটি বিল্ডিং হয়।’
লাচ্ছি ও ফালুদার অনন্য স্বাদ তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ৯৯ বছর ধরে একই স্থানে চলছে ব্যবসা। বাহাদুর শাহ্ পার্ক এলাকায় ঘোরাঘুরি অথবা আজাদ সিনেমা হলের মর্নিং শো শেষে এখানে গলা ভেজাতে আসতেন তৃষ্ণার্ত ঢাকাবাসী।
একশ বছরের পুরোনো দোকান সামলাচ্ছেন আব্দুল আজিজের উত্তরসূরি জাবেদ হোসেন। ছবি: নিউজবাংলাপুরান ঢাকার খাবারের সঙ্গে এ অঞ্চলের তৎকালীন শাসকদের যোগসূত্র রয়েছে। মহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এই শাসকরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন ধরনের খাবার। শীতল পানীয় হিসেবে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই লাচ্ছির কদর রয়েছে।
পারিবারিকভাবে বিউটি লাচ্ছি ও ফালুদা তৈরির কাজ করেন তিন জন কারিগর। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪৫ বছর ধরে সিনিয়র কারিগর হিসেবে কাজ করছেন মো. শহিদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘লাচ্ছি মজা হওয়ার একমাত্র কারণ আমাদের আগের আমল থেকে সিনিয়র কারিগররা যেভাবে তৈরি করছে, আমরা চোখে দেখে দেখে মাপটা শিখছি। আগে রাজ্জাক, শাবানা এখানে আসত। এখানে আইসা বইসা লাচ্ছি খাইত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে সবাই নিজেদের লোক। তাই পারিশ্রমিক নিয়ে কোনো কথা ওঠে না। বাকি কারিগর বা স্টাফরাও পারিবারিকভাবেই এখানে আছেন।’
মো. শহিদুল্লাহ জানান, লাচ্ছির স্বাদের মূল রহস্য হলো উপকরণের বিশুদ্ধতা। দইয়ের সঙ্গে চিনির শিরা, বিট লবণ ও নানা ধরনের মসলাপাতি যোগের পর ব্লেন্ড করে লাচ্ছি তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে গোলাপ জল, সেমাই বা নুডলস, মিষ্টি বেসিল বীজ, জেলির টুকরো, দুধের মিশ্রণে এটি তৈরি করা হয়। পরে এর ওপরে আইসক্রিম দেয়া হয়।
তিন প্রজন্মের বিউটি লাচ্ছির দোকানটি আব্দুল আজিজের পর তার সন্তান আব্দুল গাফফার মিয়া এবং বর্তমানে তার দুই সন্তান জাবেদ হোসেন ও মানিক হোসেন দেখাশোনা করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মালিক বড় ভাই জাবেদ হোসেন রায়সাহেব বাজার শাখা ও ছোট ভাই মানিক হোসেন নাজিরাবাজার শাখাটি দেখাশোনা করেন। এ ছাড়া এখন লালবাগ শাখাটি বন্ধ রয়েছে।
পুরান ঢাকার জনসন রোডে গেলেই মিলবে বিউটি লাচ্ছির দোকানজাবেদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে রাজ্জাক, শাবানা, কবরী, খলিল, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ আরও অনেক সেলিব্রিটি আসত। তবে শুধু তাদের আসার জন্য নয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্যই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।’
করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দা
মহামারির প্রভাব পড়েছে বিউটি লাচ্ছির ব্যবসাতেও। ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় মন্দায় পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
রায়সাহেব শাখার মালিক জাবেদ হোসেন জানান, করোনা মহামারির আগে গরমের সময় প্রতিদিন তাদের প্রায় ২০ হাজার টাকার বেচাবিক্রি হতো। বছরের অন্যান্য সময়ে সেটি সাধারণত ৭-৮ হাজার টাকা হয়।
মহামারির প্রকোপে ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার শুরুতেই আমাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। করোনার জন্য ঠাণ্ডা খাইতে চায় না, তাই খুলি নাই। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ বন্ধ হয়, আবার জুনে খুলা হয়, ক্রেতা না থাকায় বন্ধ হয়ে যায়।
‘দুই-তিন মাস পর আবার খোলা হয়। এরপর থেকে টুকটাক চলতে থাকে। তবে মাত্র ১ হাজার-১২শ টাকার বেচাকেনা হয়। করোনার প্রভাবে এখনও বেচাকেনা ভালো নয়। ক্রেতার সংখ্যাও অনেক কম।’
বর্তমানে তারা তিনটি দোকান গড়ে তুললেও দুটি শাখা চালু রয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, রায়সাহেব বাজারে বিউটি লাচ্ছি ও শরবতের দোকান চালু থাকলেও লালবাগের দোকানটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
জাবেদ হোসেন জানান, পুরান ঢাকায় মানুষসহ বিভিন্ন জায়গার ভোজনরসিকেরা এখানে ছুটে আসেন। দোকানে লাচ্ছি, ফালুদাসহ লেবু পানির শরবতও পাওয়া যায়। সাধারণত সপ্তাহে সাত দিনই খোলা থাকে শাখাগুলো। তবে শুক্রবার সকাল থেকে জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
তিনি জানান, বিউটি লাচ্ছির দাম ৪০ টাকা। ফালুদার দাম কিছুটা বেশি, ৭০ টাকা। লেবুর শরবত চিনি ছাড়া এবং চিনিসহ গ্লাসে ও পলিথিনের প্যাকেটে দুইভাবেই পাওয়া যায়। এর দাম ২০ টাকা। এ ছাড়া নাজিরাবাজার শাখায় ১০০ টাকায় কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
গাজীপুর থেকে ব্যবসার কাজে ঢাকায় এসেছেন মো. জাহাঙ্গীর বাবু।
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে চারবার এখানকার লাচ্ছি আর ফালুদা খাওয়া হলো। এক বছর ধরে ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় এলেই এখানে আসতে ভুল করি না। এখানকার লেবুর শরবতটাও ভালো হয়।’
পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা জাকারিয়া ইসলাম জিকো বলেন, ‘আমি এখানকার লাচ্ছি অনেক দিন খেয়েছি। এছাড়া ফালুদা, শরবত থেকে শুরু করে প্রায় সব আইটেমই খেয়েছি। কোনো ধরনের ক্ষতিকর মেডিসিন বা অন্য কিছু ব্যবহার না করেও যে ভালো কিছু তৈরি সম্ভব, সেটির একটি উদাহরণ বিউটি লাচ্ছি।’
জাবেদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমদিকে লাচ্ছির দাম ছিল এক আনা কি দুই আনা। আমাদের ব্যবসার খাবারটি আসলে শখের খাবার। এটির স্বাদ হচ্ছে ঠাণ্ডা। করোনার কারণে মানুষ ঠাণ্ডা খায় না। এ জন্য ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।
‘আমাদের ফুডপান্ডার ব্যবস্থা আছে। অনুষ্ঠান কিংবা পার্টি থাকলে আমরা সেখানে গিয়ে সবকিছু করে দিয়ে আসি। তাছাড়া কেউ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলে ফুড গ্রেডের পলিথিনে করে দিয়ে দেয়া হয়। কেউ কেউ বোতল নিয়ে আসে সেটিতে করে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে ধানমন্ডি, গুলশানে যাওয়ার চিন্তাভাবনা আছে।’