গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর প্রায় অর্ধেক অবদান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের।
তিন মাসে এই একটি ব্যাংকের খেলপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৯১ কোটি টাকা। হঠাৎ করে এত বেশি খেলাপি কেন বাড়ল, সে বিষয়ে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
খেলাপি বাড়লেও এই তিন মাসে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ কমেছে। জুন শেষে মোট ঋণ ৪২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
মার্চে তাদের মোট ঋণ ছিল ৪৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। আর ঋণের বিপরীতে খেলাপি ২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৮৫ কোটি টাকা; যা ওই সময় বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জুন শেষে খেলাপি ঋণের যে তালিকা করেছে, তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত কয়েক মাসে এনবিএলের ঋণসহ নানা বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে ব্যাপক।
এবার ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টি উঠে এলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
এ তুলনায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩২ ব্যাংকের অবস্থা ভালো। এই ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৪৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ খেলাপি।
মার্চ পর্যন্ত পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৪২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলো ২৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। আর এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর অর্ধেক এনবিএলের।
এনবিএল ছাড়াও পুঁজিবাজারের আরও তিনটি ব্যাংকের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান জয়নুল হক সিকদার। দুই সপ্তাহ পর ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কিছুদিন কোনো পর্ষদ সভা না হলেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।
গত মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে ব্যাংকটিকে নতুন করে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে নতুন করে ঋণ দিতে হলে ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি বিতরণ করা ঋণ আদায় বাড়ানোর কথা বলা হয়।
এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে ব্যাংকে ঋণসহ নানা অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১৪৬ কোম্পানিকে ৮৮৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এসব ঋণ অবৈধভাবে অনুমোদন করা হয়। এসব ঋণ ছাড় করা হয় ব্যাংকের মহাখালী, দিলকুশা, গুলশান করপোরেট ও রংপুর শাখা থেকে। এ সময়ে পর্ষদের কোনো বৈঠকও হয়নি। এসব ঋণের মধ্যে তিন কোম্পানির ৬২৬ কোটি টাকা খেলাপি করার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারীকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে এসএমএস পাঠিয়ে তার জবাব পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকটির এই পরিস্থিতি এর শেয়ারমূল্যে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। প্রথম প্রজন্মের এবং দেশের সবচেয়ে বড় পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংক হলেও এর শেয়ারদর এখন অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম।
বৃহস্পতিবার ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ব্যাংকটি লেনদেন হয়েছে ৮ টাকা ৫০ পয়সায়।
অন্য যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি
শতকরা হিসেবে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। জুন পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণ ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬৬৪ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এই হার ৭৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৫৪ শতাংশই খেলাপি।
ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণ ১৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা।
চতুর্থ অবস্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল। এর বিতরণ করা ঋণের ৩৩ দশমিক ৫৮ শতাংশই খেলাপি।
জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি বিতরণ করেছে মোট ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে আছে ৬২৯ কোটি টাকা।
পঞ্চম অবস্থানে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতা। এর বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশই খেলাপি।
জুন পর্যন্ত মোট ঋণ ৫৮ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
ষষ্ঠ অবস্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট ঋণ ৫৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে আছে ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ঋণের ১৮ দশমিক ৭৩ শতাংশই খেলাপি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের মোট ঋণ ৩৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। জুন শেষে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ।
করোনাকালে সুবিধার পরও বেড়েছে খেলাপি
করোনার মধ্যে ব্যাংকগুলোকে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা ছিল।
ধারণা করা হচ্ছিল, এ নির্দেশনার কারণে খেলাপি ঋণ কমে আসবে ব্যাংকের। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। এই সময়ে বেড়ে গেছে ঋণ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে কোনো কোনো ব্যাংকের কমেছেও।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় শতভাগ খেলাপিমুক্ত ব্যাংক অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। বাংলাদেশে কাজ করা বহুজাতিক বেশ কিছু ব্যাংকও এই খেলাপি সমস্যায় ভুগছে। আর খেলাপির বিরপীতে বেশির ভাগ ব্যাংকই সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে নিরাপদ অবস্থানেই আছে।
ব্যাংকাররা যা বলছেন
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরফান আলী বলেন, ‘যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান পুঁজিবাজার স্থিতিশীল। ব্যাংকের শেয়ার ভালো অবস্থানে আছে। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী যুক্ত। এসব বিষয়ে সব সময় কেয়ারফুল থাকতে হয়। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে। তবে এসব ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শেয়ারবাজারের বাইরের ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় লোক থাকে কম। কোম্পানি থাকে ৫ থেকে ৬ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কয়েকজনকে ম্যানেজ করে চললে হয়। কিন্তু পুঁজিবাজারে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী থাকে। সেখানে অ্যাকাউন্টেবিলিটি (জবাবদিহি), গভর্ন্যান্স (সুশাসন), রেসপনসিবিলিটি (দায়িত্বশীলতা) অনেক বেশি। এ জন্য ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ভালো করছে।’