অন্য যে কোনো পেশার মানুষের চেয়ে উড়োজাহাজের পাইলটের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপদ উড্ডয়ন বা ফ্লাইট সেফটির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ পাইলটের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা।
শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটের পাইলট মাঝ আকাশে হার্ট অ্যাটাক করলে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। ওই উড়োজাহাজে ১২৪ জন আরোহী ছিলেন।
এর আগেও ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালে ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পেছনেও পাইলটের মানসিক স্বাস্থ্যকে দায়ি করেছিল তদন্ত দল। ওই দুর্ঘটনায় ৫১ আরোহীর মৃত্যু ঘটে।
সে সময় দেশের আকাশপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে ১৩টি সুপারিশ দেয়া হয়, তার অন্যতম ছিল নির্দিষ্ট সময় পর পর পাইলটের স্বাস্থ্য পরীক্ষা। ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ ছাড়াও পাইলটের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় সারা বিশ্বেই দুর্ঘটনার অনেক নজির আছে।
২০১৬ সালে ফ্লাই দুবাইয়ের ফ্লাইট নম্বর ৯৮১ রাশিয়ার রোস্তভ অন ডন এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতে ফ্লাইটে থাকা ৫৫ যাত্রী এবং ৭ ক্রুর সকলেই নিহত হন। পরে দুর্ঘটনা তদন্তে যে কমিটি গঠন করা হয়, তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার কারণ ছিল সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পাইলটের ব্যর্থতা, যার কারণে উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন তিনি।
এর আগে ২০১০ সালে ভারতের কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ৮২১। এতে ফ্লাইটের ১৬৬ আরোহীর মধ্যে নিহত হন ১৫৮ জন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নের আগে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পাওয়ায় ক্লান্ত পাইলট ঠিকভাবে উড়োজাহাজটি অবতরণ করাতে ব্যর্থ হন।
প্রশ্ন হলো, একজন পাইলট একটি উড়োজাহাজ চালনার জন্যে সম্পূর্ণ উপযুক্ত (ফিট) কিনা, সেটি কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? কে নিশ্চিত করবে?
উড়োজাহাজের পাইলটরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট সময় পর একজন পাইলটকে বাধ্যতামুলকভাবে কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে একজন পাইলট ফ্লাইট চালানোর জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পাইলটকেই।
একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের সাবেক পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন পাইলটের লাইসেন্স নির্ভর করে তার ফিটনেসের ওপর। আমাদের এখানে যে নিয়ম আছে, তাতে প্রতি ছয় মাস বা এক বছর পরপর বাধ্যতামূলকভাবে ফিটনেস পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।
‘আর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি পরীক্ষা করা হয় যখন একজন পাইলট নতুন চাকরিতে প্রবেশ করেন বা চাকরি পরিবর্তন করেন।’
এছাড়া কোনো পাইলট যদি মনে করেন, তিনি সুস্থ বোধ করছেন না, তিনি ফ্লাইটে যেতে পারবেন না, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এতে কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করবে না।
বাংলাদেশ পাইলট এসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা এয়ারলাইনসের দায়িত্ব কীভাবে তারা তাদের পাইলটকে শারীরিক ও মানসিক চাপমুক্ত রাখবে, কারণ ফ্লাইট সেফটির ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘আমি মনে করি, একজন পাইলটের যদি তার স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হয় বা তার সন্তান অসুস্থ থাকে, তাহলেও তার ফ্লাই করা উচিত না। কারণ এ সময় তিনি মানসিক চাপে থাকেন আর চাপে থাকলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।’
অবশ্য পাইলটরা বলছেন, যদি মাঝ আকাশে কোনো কারণে উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন ফ্লাইট পরিচালনার মতো ফিট না থাকেন, বা তিনি গুরুতর অসুস্থ বোধ করেন, তাহলেও যেন ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণ করানো যায় এর জন্য সকল পাইলটকেই একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি এয়ারলাইনসের ক্যাপ্টেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন মানুষ যে কোনো সময় অসুস্থ হতে পারেন। এ বিবেচনায় আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে একটি সিমুলেটরে অংশ নিতে হয়।
‘এতে শেখানো হয় ক্যাপ্টেন অসুস্থ, আহত বা অন্য কোনো কারণে উড়োজাহাজ চালাতে অপারগ হলে কীভাবে কো-পাইলট বা ফাস্ট অফিসার উড়োজাহাজটি নিরাপদে অবতরণ করাবেন। এটা বিভিন্ন ধাপে করানো হয়ে থাকে, যে কারণে ক্যাপ্টেনের অবর্তমানে ফ্লাইটে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চিফ ফ্লাইট অপারেশনস ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন পাইলটের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকি, যার একটি হলো প্রতি ছয় মাস পরপর চল্লিশোর্ধ পাইলটদের জন্য বাধ্যতামুলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
‘অর্থাৎ প্রতি ছয় মাস পরপর একজন চল্লিশোর্ধ পাইলটকে অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে এবং এটা খুব গুরুত্বের সাথে নিরীক্ষা করা হয়। এতে যদি কোনো জটিলতা ধরা পড়ে, তাহলে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর বাইরেও যদি কোনো পাইলটের শারীরিক সমস্যার কোনো অতীত রেকর্ড থাকে, নিয়ম অনুযায়ী সেটি জানাতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই ছয় মাসের মধ্যেও যদি কোনো পাইলট শারীরিক অসুবিধা বোধ করেন, নিয়ম অনুসারে তাকে সেটা সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। অনেকেই এটি জানাতে চান না। আর এটার কারণেও অনেক সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়।’