নাম চশমার খাল। চট্টগ্রাম নগরের মেয়র গলি এলাকায় এ খালের পাশে মূল সড়কে চলাচল করে বিভিন্ন যানবাহন। খাল ও সড়কের মাঝে ফুটপাত।
ফুটপাতের উচ্চতা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় পথচারী ও সড়কের যাত্রীরা একটু অসতর্ক হলেই পড়ে যান খালে। পড়ে যায় যানবাহনও। এতে মারাত্মক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেক। মির্জাপুর, রেজু, মহেশ খালসহ এমন ঝুঁকিপূর্ণ আরও কয়েকটি খাল রয়েছে নগরে।
চট্টগ্রাম নগরে এমন অসংখ্য খাল ও নালা দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় যাত্রীদের কথা ভেবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্লাব বসিয়ে এগুলোর কোথাও কোথাও ঢেকে দেয়া হয়েছিল। তবে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় স্লাবগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। বেশির ভাগ খালের পাশের পুরোনো প্রতিরোধক দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। এতে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনজন প্রাণ হারান।
চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তা পার হওয়ার সময় পা পিছলে চশমা খালে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যান নগরের চকবাজার এলাকায় ব্যবসায়ী ছালেহ আহমেদ। মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার জন্য মুরাদপুরে এসেছিলেন তিনি। সেখান থেকে বাসে করে দরবার শরিফে যাওয়ার কথা ছিল তার। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল তার খোঁজ পায়নি।
এর আগে ৩০ জুন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সুলতান আহমদ ও যাত্রী খাদিজা বেগমের মৃত্যু হয়। খালের পাশে সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় অটোরিকশাটি পিছলে পড়ে যায় খালে।
চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার কারণে গত ছয় বছরে নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সবাই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় থাকা খাল-নালায় পড়ে মারা গেছেন।
চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের অধীনে নগরের প্রধান খালগুলো খনন, দুই পাশে রিটেইনিং ওয়ালসহ নানা অবকাঠামোর কাজ করা হচ্ছে। এ কারণে খালের পাশে প্রতিরোধক দেয়াল ভেঙে ফেলায় পাড় দিয়ে চলাচল করতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লোকজন।
অনেকে পা পিছলে পড়ে যান খালে। অবস্থা বেশি বেগতিক হয় বৃষ্টির সময়। কারণ হালকা বৃষ্টিতেই নগরের সড়ক-খাল-নালা পানিতে একাকার হয়ে পড়ে। তখন সড়ক, নালা বা খালকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেন না পথচারীরা।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, দায়সারা কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। যাত্রী বা পথচারীদের জন্য নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থা করা ছাড়াই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো যেখানে-সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছে। খালগুলো উন্মুক্ত রাখছে।
নগরের মুরাদপুর এলাকার ব্যবসায়ী তবারুক তাহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বুধবার যে জায়গায় ব্যবসায়ী পানিতে তলিয়ে গেছেন সেখানে আগে কালভার্ট ছিল। খাল খননের জন্য সেই কালভার্ট ভেঙে ফেলা হয়েছে। তারপর থেকে খালটি উন্মুক্ত। কালভার্ট থাকলে ওই লোক দুর্ঘটনায় পড়তেন না।’
নগর পরিকল্পনাবিদরা জানিয়েছেন, উন্মুক্ত খালগুলোর পাশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সতর্ক সংকেতের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো প্রাণহানি দিন দিন বাড়বে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক ও নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার হোসেন মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এভাবে খাল উন্মুক্ত রেখে উন্নয়নকাজ হয় না। সিডিএ পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া দায়িত্ব এড়াচ্ছে। শহরজুড়ে থাকা খালগুলোয় পানি উঠলে তা মরণফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সিডিএর উচিত প্রতিটি খালের বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে সতর্কতা সংকেত দেয়া। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
খাল-নালায় পড়ে এত মানুষের মৃত্যুকে নিছক বিপদ হিসেবে দেখছেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী বলেন, ‘বিপদ কাউকে বলে আসে না। বৃষ্টির কারণে কাজ বন্ধ আছে। কাজ চলাকালীন সতর্কবার্তা থাকে। কাজ শুরু করার আগেও খালটি উন্মুক্ত ছিল। আর এলাকার লোকজন তো জানে রাস্তার পাশে খাল আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তার পাশে ফুটপাত, সেটা পেরিয়ে নালা। ফুটপাত মূল সড়ক থেকে কিছুটা উঁচুতে। তবে কাজ শেষ হলে আমরা আরও উঁচু করে দেব যেন গাড়ি ফুটপাতে উঠতে না পারে। একই সঙ্গে খালের দুই পাশে ছোট করে রঙিন রেলিং দিয়ে দেব যেন মানুষ বুঝতে পারে এটা নালা বা খাল।’
কচ্ছপ গতিতে চলছে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প
দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সিডিএর প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। সিডিএর ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রথম দফায় ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে খালের আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকল্পের কার্যক্রম। ইতিমধ্যে নগরের খালগুলো থেকে ৩ হাজার ১৭৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। এখন আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ।’
বিলীন হয়ে গেছে ১২টি খাল
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে মহানগরীর প্রথম ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান জনস স্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি। নগরের পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমি থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৩৪টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে ম্যাপ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরিচালিত জরিপে খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। অর্থাৎ ৫০ বছরে ১২টি খাল বিলীন হয়ে গেছে।
এ ছাড়া বিদ্যমান ২২টি খালের একটি বড় অংশই সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বছরের পর বছর দখল হয়েছে। খালের জায়গায় বহুতল ভবন হয়েছে। এ ছাড়া অবাধে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে ভরাটও হয়েছে খালগুলো। এতে করে খালের স্বাভাবিক গতিপথও ব্যাহত হয়েছে। স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় খালগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সরছে না।
জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের আওতায় দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে। পাশাপাশি খাল খনন করা হচ্ছে। তবে মানুষ সচেতন না হলে এর সুফল মিলবে না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১২টি খাল বিলীন হয়ে গেছে। শত শত টন বর্জ্য নানাভাবে প্রতিদিনই খালে পড়ছে। খাল খনন করার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে একদিকে খাল খনন করলে অন্যদিকে ময়লার ভাগাড় তৈরি হচ্ছে। এভাবে চললে খননের সুফল পাওয়া যাবে না।’