সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত ১০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণার পরপর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এই খাত নিয়ে আবার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৯ আগস্টের পর আট কর্মদিবস শেষে আবার এক দিনে এই খাতে লেনদেন ছাড়াল ১০০ কোটি টাকা। ১১৫ কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়েছে খাতটিতে।
আগের দিন রেইসের ১০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড গত ৩০ জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর আগেও ১৭টি ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছ, যার মধ্যে আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পরিচালিত কয়েকটি ফান্ড ছাড়া বাকি সবগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তা যেকোনো সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে বেশি।
তার পরেও ফান্ডগুলো ক্রমেই দর হারাচ্ছিল, আর বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ যে কমে আসছিল, তার প্রমাণ লেনদেনে।
বছরের পর বছরের খরা কাটিয়ে গত ৩, ৫ ও ৯ আগস্ট পরপর তিনটি কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছিল ১০০ কোটি টাকার বেশি।
৩ আগস্ট লেনদেন হয় ১০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ৫ আগস্ট তা আরও বেড়ে হয় ১৪২ কোটি ৮ লাখ টাকা। তবে ৯ আগস্ট তা কমে দাঁড়ায় ১৩২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
কিন্তু এর পরেই তা ১০০ কোটি টাকার ঘরের নিচে চলে আসে, যদিও দৈনিক লেনদেন ক্রমেই বাড়তে বাড়তে ৩ হাজার কোটি টাকার ঘর প্রায় ছুঁয়ে ফেলে দুই দিন।
এর মধ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ আসতে থাকে। আর ৪ আগস্ট এনএলআই মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৭৫ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করে চমক দেখায়। এটি গত বছর লোকসানে ছিল আর এ কারণে লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
ফান্ডটির দাম সেদিন ছিল ১৮ টাকার ঘরে। এই হিসাবে ফান্ডের মূল্যের প্রায় ১০ শতাংশ পাওয়া যাবে লভ্যাংশ হিসেবে। কিন্তু এ খবরে সেদিন ফান্ডটি দর হারায় ৬০ পয়সা।
এরপর ৯ টাকার ঘরে দাম- এমন দুটি ফান্ড ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ২০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এদের ক্ষেত্রে ইউনিট মূল্যের ১৩ শতাংশের মতো হয় লভ্যাংশ।
এর পরেও যেসব ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তার সিংহভাগের লভ্যাংশেই ব্যাংকে যেকোনো সঞ্চয়ী হিসাব তো বটেই, সঞ্চয়পত্রের সুদহারের চেয়েও বেশি আসে।
আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পরিচালিত আটটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড চাঙা পুঁজিবাজারেও ভালো মুনাফা করতে ব্যর্থ হলেও যে লভ্যাংশ এসেছে, তা ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে বেশি। কারণ, ফান্ডগুলোর ইউনিট মূল্য এক-দুইটা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম।
আইসিবির ফান্ডগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার পর লেনদেন আরও কমতে থাকে।
১১ আগস্ট লেনদেন হয় ৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। পরের দিন হয় ৭৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
১৬ আগস্ট লেনদেন ছিল ৬৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, পরের দিন ৭৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এরপর ১৯ ও ২৩ আগস্ট পরপর দুই কর্মদিবসে তা ৫০ কোটির নিচে নেমে আসে। ১৯ আগস্ট লেনদেন ছিল ৪২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর ২৩ আগস্ট ৪৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
তবে রেইসের লভ্যাংশ ঘোষণার আগের দুই দিন লেনদেন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২৪ আগস্ট লেনদেন ছিল ৬২ কোটি ৭০ লাখ টাকা আর লভ্যাংশ ঘোষণার দিন ২৫ আগস্ট ৭২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
রেইস যে ১০টি ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তার ইউনিট মূল্যের তুলনায় লভ্যাংশ ১২ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি এসেছে ৪টির, ১০ শতাংশের বেশি এসেছে ৩টির, ৮ শতাংশের বেশি এসেছে ২টির। আর সবচেয়ে কম লভ্যাংশ দিয়েছে যেটি, সেটিও তার ইউনিট মূল্যের তুলনায় ৬ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে।
সব মিলিয়ে ১০টি ফান্ড ২২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সবগুলো ফান্ডের দামের বিপরীত গড় লভ্যাংশ হয় ১০ শতাংশের বেশি।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ নিলে বিনিয়োগকারীর প্রকৃত আয় বেশি হয়, এ কারণে যে এই লভ্যাংশের ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোনো হিসাবে লভ্যাংশে ১০ শতাংশ কর কাটে। ফলে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বেশি হয়।
দর বাড়ল রেইসের ৫ ফান্ডের, কমলও সমপরিমাণ
রেইসের এই লভ্যাংশ ঘোষিত হয়েছে ২৫ আগস্ট পুঁজিবাজারে লেনেদেন শেষে। আর ২৬ আগস্ট লেনদেন শুরুর আগে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েসসাইটে দেয়া হয়।
দারুণ লভ্যাংশ ঘোষণার পরেও দামে খুব একটা হেরফের হয়েছে এমন নয়। ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৩০ পয়সা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করা ফার্স্ট জনতা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটপ্রতি দর ৪০ পয়সা ও ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটপ্রতি দর বেড়েছে ৬০ পয়সা।
বাকিগুলোর মধ্যে ৮৫ পয়সা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করা পপুলার ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ২০ পয়সা আর পিএইচপির ইউনিট মূল্য বেড়েছে ১০ পয়সা।
ইউনিটপ্রতি ৯০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করা ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট মূল্য বেড়েছে ১০ পয়সা।
রেইসের যে ৫টির লভ্যাংশ কম এসেছে, তার সবগুলো দর হারিয়েছে। ১০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ পয়সা কমেছে ইউনিটপ্রতি
অন্যদিকে ইউনিটে ৮০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করা এবি বাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ১০ পয়সা, ৭৫ পয়সা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করা এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪০ পয়সা এবং আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ১০ পয়সা দর হারিয়েছে।
সবচেয়ে কম লভ্যাংশ ঘোষণা করা দুই ফান্ডের মধ্যে ৬০ পয়সা করে দেয়ার ঘোষণা করা ইবিএল এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪০ পয়সা ও ৪০ পয়সা করে দেয়ার ঘোষণা করা এফবিএফআইএফের ইউনিটপ্রতি দর হারিয়েছে ৩০ পয়সা।
চমক লেনদেনে
দাম বৃদ্ধি ও কমার হার সমান সমান হলেও রেইসের ফান্ডগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার পর চমক এসেছে লেনদেনে। এদিন মোট ১১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার ইউনিট বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন, এটাই প্রমাণ হবে, এই খাতকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য উপযোগী বলে মনে করছেন তারা।
সবচেয়ে বেশি ১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে ফার্স্ট জনতায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ২৯ আগস্ট লভ্যাংশ ঘোষণা করতে যাওয়া গ্রামীণ টুতে; ১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
ঘোষিত লভ্যাংশে নাখোশ হয়ে কম দামে ছেড়ে দিলেও এফবিএফআইএফে লেনদেন হয়েছে ব্যাপক, হাতবদল হয়েছে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
ভালো লভ্যাংশের ইঙ্গিত ছিল আগেই
মিউচ্যুয়াল ফান্ড যে এবার চমক দেখাবে, তা বোঝা যাচ্ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষেই। এক প্রান্তিকে কোনো কোনো ফান্ড দেড় থেকে দুই টাকার বেশি মুনাফা করে।
ডিসেম্বর শেষে ফান্ডগুলোর মুনাফা আরও বাড়ে। এরপর জানুয়ারি থেকে মার্চে পুঁজিবাজারে বড় সংশোধন হলেও ফান্ডগুলো খুব একটা লোকসান দিয়েছে এমন নয়। আর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাজারে ছিল উত্থানের দ্বিতীয় পর্ব। এই তিন মাসে সূচক বাড়ে ৮৮০ পয়েন্ট।
মুনাফার তুলনায় লভ্যাংশ কম কেন?
মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা অনুযায়ী, ফান্ডগুলো যত মুনাফা করবে, তার ৭০ শতাংশ বিতরণ করবে নগদে।
কিন্তু এখানে আরও একটি বিষয় আছে, যে কারণে প্রকৃত লভ্যাংশ কম এসেছে, এবং সেই বিষয়টি অনেক বিনিয়োগকারীই বুঝতে পারেননি।
যেমন: আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিটে মুনাফা করেছে ২ টাকা ৩২ পয়সা, কিন্তু পপুলার ফার্স্ট করেছে ২ টাকা ৮ পয়সা। অথচ পপুলারের লভ্যাংশ বেশি আর তা ৭০ শতাংশ হয়নি।
এর কারণ গত বছরের লোকসান।
আগের বছর লোকসান দিলে সেই পরিমাণ লোকসান সংরক্ষণ করতে পারবে ফান্ডগুলো আর এটি আসলে তাদের আর্থিক ভিত্তিকেই শক্তিশালী করবে। ফলে এতে কার্যত ইউনিটধারীদের কোনো লোকসান হয় না। কারণ, ফান্ডগুলোর মেয়াদ শেষে যখন সেগুলো ভাঙিয়ে অর্থ বিনিয়োগকারীদের দেয়া হবে, তখন তার সুফল পাবে তারা।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের লোকসান সব সমন্বয় হয়ে যাওয়ায় ফান্ডের ইউনিটধারীরা আগামী বছর তার সুফল পাবেন। বাজার যদি স্থিতিশীল থাকে আর ইউনিটপ্রতি আয় যদি সমানও থাকে, তাহলে আগামী বছর আইএফআইসি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটধারীরা ১ টাকা ৬০ পয়সার বেশি আর পপুলার ফার্স্টে ইউনিটধারীরা পাবেন ১ টাকা ৫০ পয়সার মতো। তখন তা এটি তাদের ইউনিট মূল্যের প্রায় ২০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণাপ্রধান দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম থাকার কারণ ছিল, বিনিয়োগকারীরা যে উদ্দেশ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতেন, বিপরীতে রিটার্ন পেতেন না। ফলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হননি। কিন্তু রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট দেয়ার বিষয়টি বাতিল করায় এখন বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন।’
তিনি বলেন, ‘ফান্ডগুলো ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে। সেটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পুঁজিবাজারে ভারসাম্য রক্ষায় এগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।’
পুঁজিবাজারে মোট ফান্ডের সংখ্যা ৩৬টি। এর বাইরে তালিকাভুক্ত নয়, এমন ফান্ডের সংখ্যা ৪৫টির মতো। এগুলোর বেশির ভাগের অর্থবছর জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত।