রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে তার মরদেহ নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিষয়টি বিএনপি নেতারা জানেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আয়োজনে গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে গিয়ে যে মারামারি করল বিএনপি, তারা জানে না যে সেখানে জিয়ার কবর নাই, জিয়া নাই ওখানে, জিয়ার লাশ নাই? তারা তো ভালোই জানে। তাহলে এত নাটক করে কেন? খালেদা জিয়াও ভালোভাবে জানে।
‘খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া কি বলতে পারবে তারা তাদের (স্বামী ও) বাবার লাশ দেখেছে? গুলি খাওয়া লাশ তো দেখাই যায়। তারা কি দেখেছে কখনো বা কেউ কি কোনো ছবি দেখেছে কখনো? দেখেনি। কারণ ওখানে কোনো লাশ ছিল না। ওখানে একটা বাক্স আনা হয়েছিল। সেখানে ওই বাক্সের ফাঁক দিয়ে যারা দেখেছে, সেই এরশাদের মুখ থেকেই শোনা, কমব্যাট ড্রেস পড়া ছিল। জিয়াউর রহমান তখন প্রেসিডেন্ট। সে তখন কমব্যাট ড্রেস পড়ে না। এটা কি বিএনপির লোকরা জানে না?’
বিএনপির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘তাদের মারামারি, ধস্তাধস্তি করার চরিত্র তো এখনও যায়নি। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী চক্র, দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি সমর্থন তাদের সবসময় ছিল, এটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের।’
‘জিয়া ফিল্ডে যুদ্ধ করেছে এমন ইতিহাস নেই’
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও জিয়াউর রহমান সরাসরি ময়দানে যুদ্ধ করেছেন এমন ইতিহাস নেই বলে জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয় প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় তখন ইপিআর হেডকোয়ার্টারে।
‘পূর্ব থেকে যেহেতু প্রস্তুতি ছিল, স্বাধীনতার যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা ওই ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমেই সেটা প্রচার করে দেয়া হয়। যখন তারা আক্রমণ শুরু করে তার পরবর্তীতে যে চারজন সেখানে ছিলেন, সুবেদার মেজর শওকত আলীসহ তারা কিন্তু পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। দীর্ঘদিন অত্যাচার করে তাদের হত্যা করা হয়।’
মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সেই সোয়াত জাহাজ থেকেই অস্ত্র আনতে গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের ঘোষণার পরেও কিন্তু জিয়াউর রহমান পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবেই কাজ করছিল। চট্টগ্রামে আমাদের নেতা-কর্মী যারা ব্যারিকেডে দিচ্ছিল, তার হাতে কিন্তু অনেকেই নিহত হয়েছে।
‘জাতির পিতার ঘোষণাটা ২৬ তারিখ দুপুরবেলা চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাহেব প্রথম পাঠ করেন। এরপর একে একে আমাদের সেখানে যারা নেতৃবৃন্দ তারা সবাই পাঠ করেন। সে সময় নেতাদের মধ্যেও একটি কথা ছিল যে একজন সামরিক অফিসারকে দিয়ে যদি ঘোষণাটা পাঠ করানো যায়, তাহলে যে যুদ্ধ হয়েছে, সে যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হবে। তখনই জিয়াউর রহমানকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়।’
তিনি বলেন, ‘মেজর রফিক তার বইয়ে স্পষ্ট লিখেছেন। প্রথমে তাকে বলা হয়। কিন্তু তিনি তখন পাকিস্তান আর্মির সাথে যুদ্ধ করছেন এবং অ্যামবুশ করে বসে আছেন। তিনি বলছেন, আমি যদি সরে যাই তাহলে ওরা এটা দখল করে নেবে। জিয়াউর রহমানকে যখন ধরে আনা হলো কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তাকে দিয়ে ঘোষণাটা পাঠ করানো হলো। সেভাবেই জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।
‘এ কথাটা সত্যি যে জিয়াউর রহমান যে কোনো ফিল্ডে বা কোথাও যুদ্ধ করেছে এমন ইতিহাস শোনা যায় না। আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আহত হয়েছে; বিভিন্ন ফিল্ডে যুদ্ধ করেছে কিন্তু তার (জিয়া) কিন্তু এমন কোনো ইতিহাস নেই।’
‘জিয়াই ছিলেন মোশতাকের ক্ষমতার উৎস’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে নিয়েই ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানকেই পেয়েছিল খন্দকার মোশতাকরা দোসর হিসেবে। সেই ছিল তার মূল শক্তির উৎস। কারণ ক্ষমতা যদি এভাবে দখল করতে হয় আর হত্যাকাণ্ড চালাতে হয় তাহলে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন।
‘সেই মোশতাক-জিয়া মিলেই চক্রান্তটা করেছিল। মোশতাক, জিয়ার ওপর নির্ভর করে যে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল আপনারা যদি একটু লক্ষ্য করেন সে কতদিন থাকতে পেরেছিল? থাকতে কিন্তু পারে নাই। মীরজাফরও পারে নাই। কারণ বেইমানদের ব্যবহার করে সবাই। তাদের কেউ বিশ্বাস করে না, রাখে না। জিয়াউর রহমানও সে কাণ্ডই করেছিল। মোশতাক কিন্তু তিন মাসও পূর্ণ করতে পারে নাই, তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। জেলখানায় যে হত্যাকাণ্ড হয়, সেটাও কিন্তু জিয়াউর রহমানের নির্দেশে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৩২ নম্বরে রাসেলকে হত্যার উদ্দেশ্যটাই ছিল, খুনি রশিদ-ফারুকদের কথাই আছে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের যেন কেউ না থাকে। এই ৩২ নম্বরেই কিন্তু আমি একটি বাসার দোতলায় ভাড়া থাকতাম। সেখানেও কিন্তু আর্মি গিয়েছিল। আমি যেহতু বিদেশে ছিলাম…আমার একটি ফ্রিজে কিন্তু গুলির দাগও ছিল। মাত্র ১৫ দিন আগেই তো আমরা দেশ ছাড়ি। তখন তো ভাবতেও পারিনি যে এভাবে এক দিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে।
‘কিন্তু ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত যে হচ্ছে, এটা শোনা যেত। আব্বা তো সেটা বিশ্বাস করতেন না। তিনি তো বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাকে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এমনকি ইন্দিরা গান্ধী নিজেও বলেছেন। উনি বলেছেন ওরা আমার ছেলে; আমার সন্তানের মতো। ওরা আমাকে কেন মারবে? উনার একটা অন্ধ বিশ্বাস, এ দেশের মানুষের প্রতি ছিল যে, উনার গায়ে কেউ হাত দেবে না।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘মাত্র সাড়ে তিন বছর জাতির পিতা হাতে পেয়েছিলেন দেশ গড়ার। এই সাড়ে তিনটা বছরও কিন্তু তাকে সেভাবে সময় দেয়া হয়নি। যেদিন থেকে তিনি বাংলার মাটিতে পা রাখলেন তার পর থেকেই কিন্তু ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা, চেতনাকে ধ্বংস করা, স্বাধীনতার আদর্শকে নস্যাৎ করা এটাই ছিল এদের লক্ষ্য।
‘কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমাদের দলের ভেতরে আমার বাবার মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাকসহ যারা জড়িত ছিল, আর তাদেরই মূল শক্তি ছিল। সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধান হয়, কিন্তু উপ-সেনাপ্রধান বলে কেউ হয় না। তবে জেনারেল জিয়াউর রহমান…মুক্তিযোদ্ধা যারাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবাইকেই অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
‘কাজেই তার সংসারটা টিকিয়ে রাখতে তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সে কর্মরত ছিল। সেখান থেকে নিয়ে এসে ঢাকায় উপ-সেনাপ্রধান করে তাকে রেখেছিল। কিন্তু সে কখনো বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না, স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না।’
আওয়ামী লীগের প্রধান বলেন, ‘প্রচার পেয়েছে জিয়া নাকি গণতন্ত্র দিয়েছে। যে দেশে প্রতি রাতে কারফিউ থাকে সেটা আবার গণতন্ত্র হয় কীভাবে? ভোট চুরি থেকে শুরু করে সবকিছুই কিন্তু এই জিয়াউর রহমানই শুরু করেছে। এমনকি সংবিধান লঙ্ঘন করা, সেটাও জিয়াউর রহমান করেছে।
‘যা হোক আমাদের সৌভাগ্য যে হাইকোর্টের একটা রায় যে, জিয়ার ক্ষমতা দখল, এরশাদের ক্ষমতা দখল, মার্শাল ল’ দিয়ে যে ক্ষমতা দখল সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।’
‘কেউ এগিয়ে আসেনি কেন?’
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যার রাতে ফোন করেও বঙ্গবন্ধু বাইরে থেকে কোনো সহযোগিতা কেন পেলেন না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘ঘাতকের দল এই হত্যাকাণ্ড করে বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়েছিল রেডিওতে প্রথম। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ, পাকিস্তানি কায়দায়। এভাবে সব নামগুলি একসময় পরিবর্তন করে দেয়।
‘তবে তা ধরে রাখতে তারা পারেনি। কারণ এই অন্যায় কখনো আল্লাহও মেনে নেয়নি; বাংলাদেশের মানুষও মানেনি। তেব হ্যা সেদিন বাংলাদেশে এটা ঠিক যে এরকম একটি ঘটনার পর আমাদের দল, সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা ছিলো তা হয়তো তারা করতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটা আপনারা জানেন, যখনই বাড়ি আক্রমণ শুরু হয় প্রথমে সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় বা শেখ মনির বাসায় এবং আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সাথে কথা হয়, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সাথে কথা হয়।
‘সেনাবাহিনীরও যার যা ভূমিকা ছিল, তারাও কিন্তু সঠিকভাবে করে নাই। এর পেছনের রহস্যটা কী, সেটাই কথা।’
‘দেশে ফিরে চেনা মুখ পাইনি’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানির উদ্দেশে রওনা হন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই স্মৃতিচারণ উঠে আসে। কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে আওয়ামী লীগ আসার পরেও যতটুকু উন্নতি হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি থাকতেন তাহলে ৪০ বছর আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পেত। বাংলাদেশের জনগণকে কিন্তু সেখান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
‘জানি না, আল্লাহ হয়তো বাঁচিয়েও রেখেছিলেন। আমার তো বাবা, মা, ভাই সব হারিয়ে যেদিন বাংলার মাটিতে পা দিলাম… আমাকেও তো আসতে অনেক বাধা দিয়েছে। তারপরেও জোর করেই এসেছি। হ্যাঁ, আমি সেই চেনা মুখগুলো পাইনি। বনানীতে সারি সারি কবর পেলাম।’
পরিবার হারিয়ে প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ ও দেশের মানুষকেই আপনজন মনে করার কথা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল চোখে বলেন, ‘পেয়েছি লাখো মানুষ, আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। তাদের ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস। এ জন্য আমি বলতে পারি আওয়ামী লীগটাই আমার পরিবার, বাংলাদেশটাই আমার পরিবার।
‘আমি সেইভাবেই বাংলাদেশের মানুষকে দেখি। যতটুকু কাজ করতে পারব মনে হয়, আমার আব্বা, আম্মা তারা নিশ্চয়ই দেখবেন, হয়তো তাদের আত্মাটা শান্তি পাবে। আমি সেই চিন্তা করেই সব কাজ করি। এ জন্য আমার কোনো মৃত্যু ভয়ও নেই, কোনো আকাঙ্ক্ষা বা চাওয়া-পাওয়া নেই।’
তিনি বলেন, ‘নিজের জন্য আমি কিছু করবই না, করতেও চাই না। আমি শুধু এটুকু চাই, যড়যন্ত্রকারীরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে, তাদের উদ্দেশ্য তো ছিল বাংলাদেশ ফেইলড রাষ্ট্র হোক। সেটাই করতে দেবো না।
‘যে নাম তারা মুছে ফেলেছিল ২১ বছর, আজকে সেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখন আর কেউ তা মুছতে পারবে না।’