দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ১৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এই সংখ্যাটি দুই কোটির কাছাকাছি।
মানসিক রোগে মৃত্যুর সংখ্যাটি সামনে না এলেও এটি আঁতকে উঠার মতো। রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে প্রাণহানির সংখ্যা করোনায় যত মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি।
মৃত্যুর সংখ্যাটি অবশ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে করোনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান আছে, যা থেকে মানসিক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা কত, তার ধারণা পাওয়া যায়।
গত বছরের মার্চে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার ৫২৭ জনের।
বুধবার সন্ধ্যায় এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কৌশল উদ্বোধন করে এসব কথা জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
ফ্লোরা যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত অন্তত পৌনে ২ কোটি মানুষ। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ২৭ লাখ ৯৩ হাজার। গত তিন বছরে সেটি নিশ্চিতভাবেই আরও বেড়েছে।
১০ কোটি ৪০ লাখের বয়স যদি এখন ১৮ বছরের বেশি হয়, তাহলে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যাটি এক কোটি ৭৬ লাখের বেশি।
সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বাংলাদেশে শতকরা ১৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বর্পূণ।’
সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক সেবার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে বলেও জানান সেব্রিনা। বলেন, ‘সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত এজেন্ডার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি সাধন বর্তমানে অন্যতম একটি অঙ্গীকার। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে মাল্টিসেক্টোরাল পন্থায় কাজ করতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ জাতি, মানসিকভাবে সুস্থ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যত মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকার ও অন্যান্য অংশীদারের পাশাপাশি কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করে ব্র্যাক।
ব্র্যাকের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কৌশলের প্রধান প্রেক্ষিতটি সাংস্কৃতিকভাবে সঙ্গতির্পূণ, শ্রদ্ধাশীল এবং সহানুভূতিশীল মনোভাবকে আত্মীকরণ ও সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
নীতিকৌশলটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও লোকশিক্ষা, কুসংস্কার দূরীকরণ এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ও চাহিদাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করে যাবে।
অনুষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কৌশলটির বিবরণ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি)-এর পরার্মশক এবং অক্সফোর্ডের কনসাল্টিং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নার্গিস ইসলাম।
কৌশলটির মূল উপাদান এসেছে একটি প্যারা কাউন্সিলর মডেল থেকে। এই মডেলটি তৈরি করেছে ব্র্যাক আইইডি এবং ইতোমধ্যেই এর বাস্তবায়নও করেছে।
প্যারা-কাউন্সেলিং মডেল বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে ব্র্যাক আইইডি-র নির্বাহী পরিচালক ইরাম মারিয়াম বলেন, ‘আমরা এটাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলিনি। কিন্তু গত ৪৯ বছর ধরে আমরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকেছি, সমর্থন ও আশা যুগিয়েছি। তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করেছি।
‘আমাদের আজকের এই উদযাপনের মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, যখন আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের উপর ভিত্তি করে ব্র্যাকের জন্য প্রথম মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কৌশলটি প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে পেরেছি।’
কৌশলটির ভিত্তিতে প্রণীত ব্র্যাকের মানসিক স্বাস্থ্য মডেলটির পাইলট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তুলে ধরেন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক মোর্শদা চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ব্র্যাকের এই কৌশল স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ তখনই প্রত্যাশিত ফলাফল আনবে যখন সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে টেকসই অংশীদারত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হবে। প্রকৃতপক্ষে এই কৌশলের সফল বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই অগ্রসর হবে ব্র্যাক।’
সভাপতির বক্তব্যে ব্র্যাকের র্নিবাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘কোভিড -১৯-এর পটভূমি আমাদের ওপর গভীর মানসিক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এতে করে সবার জন্য এই সেবা উন্নত করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশের কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর জন্য ব্র্যাক এই সমন্বিত কৌশলটি প্রণয়ন করেছে।
‘এখন এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সহযোগী সকলকে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের র্নিবাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্। সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ।