গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাতে আর ছিল কেবল দেড় মাসের অপেক্ষা। এরপরেই হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে খর্বাকৃতির গরু হতে পারত রানি। এর আগে হঠাৎ মৃত্যু হয় প্রাণীটির।
সাভারের এই আলোচিত গরুর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকর্মীরা সরাসরি পান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছ থেকে। তবে শুরুর দিকে এই তথ্য অস্বীকার করেন রানির মালিক। পরে বিষয়টি স্বীকার করে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
সংবাদকর্মীদের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রানি আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। তাকে শেষ সময়ে চিকিৎসার জন্য আনা হয়।
এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর রানির মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন এলাকার লোকজন। ফেসবুকেও অনেকে এ নিয়ে পোস্ট দেন। তাদের ধারণা, গিনেসে নাম লেখাতে খামারমালিক মরিয়া হওয়ায় রানির অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুর বিষয়টিও ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন।
রানির মৃত্যুর দুই দিন আগে তার খোঁজ নিতে আশুলিয়ার কুরগাঁও এলাকার শিকড় অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের ওই খামারে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক। তখন তাকে খামারে ঢুকতে দেয়া হয়নি। দেখতে দেয়া হয়নি রানিকে।
কারণ জানতে চাইলে খামারের একজন বলেন, স্টাফদের অসুস্থতার কারণে মালিকের নির্দেশে সেখানে প্রবেশ একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে সেদিনই ফোন দেয়া হয় খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. আবু সুফিয়ানকে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, তাদের নিজস্ব প্রাণিচিকিৎসক নিয়মিত রানিকে দেখতে আসেন। রানি সুস্থ আছে।
এর দুই দিন পর বৃহস্পতিবার সাভার উপজেলার উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল মোতালিব নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন, রানি মারা গেছে। মুমূর্ষু অবস্থায় গরুটিকে তার কাছে আনা হয়। তাই তাকে বাঁচানো যায়নি।
রানির অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মঙ্গলবার খামার এলাকায় যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক, কথা বলেন আশপাশের লোকজনের সঙ্গে। তারা জানান, আগে রানিকে খামারের যে অংশে রাখা হতো, সেটি বাইরে থেকেই দেখা যেত। তবে, বেশ কিছুদিন ধরে রানিকে সেখান থেকে সরিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। খামারে দর্শনার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশও বন্ধ করে দেয়া হয়।
ওই খামারের পাশেই বাড়ি লোকমান হোসেনের। স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনিই রানির বিষয়ে খোঁজখবর দিতেন। তার দাবি, গত বৃহস্পতিবার তিনিই প্রথম জানতে পেরেছিলেন যে রানি মারা গেছে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে রানিরে আমি খামারে দেখি নাই। করোনার কারণে ওনারা আমাদের ঢুকতে দিত না লোকজন অনেক বেশি হয় দেইখা। এই কারণে আমিও যাইতাম না। এলাকার লোকজন প্রাচীরের ওপর দিয়া রানিরে দেখার চেষ্টা করত।
‘বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভারের সরকারি পশু হাসপাতালের একজন পরিচিত লোক আমারে ফোন করে জানাল, ভাই পাঁচ মিনিট আগেই রানি মারা গেল। বলছে, আমার চোক্ষের সামনে মারা গেছে। পরে আমি সাংবাদিকদের ফোন দিয়া জানাইছি।’
পশু চিকৎসক মো. আতিকুজ্জামান ওই খামারে গিয়ে নিয়মিত রানিকে দেখতেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার দুই-তিন দিন আগেও আমি খামারে গিয়ে রানিকে দেখে এসেছিলাম। তখন স্বাভাবিক ছিল। কোনো সমস্যা ছিল না।
‘ওইদিন (বৃহস্পতিবার) সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ করেই আমাকে ফোন দিছে। বলছে যে, এই রকম পেট ফুলে গেছে। তখন আমি বলছি, আমি উপজেলা পশু হাসপাতালে আছি পাঠায় দেন।’
মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের পার্সোনাল ডাক্তার না। আমি আরেকটা কোম্পানিতে (এসআই গোদরেজ) জব করি। তবে ওখানে মাঝে মধ্যেই যাওয়া হয়। আমার মনে হয়, পেটে অতিরিক্ত পরিমাণ গ্যাস জমে গিয়েছিল। গ্যাস জমে পেটটা ফুলে গিয়েছিল।
‘গ্যাস তো অনেক কারণেই জমতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে, দানাদার খাবার গুঁড়া, ভুসি এগুলা খাওয়াইলে পেটে গ্যাস জমে যায়। তা ছাড়া রানি যেহেতু বামন টাইপ, তাই ইমিউনিটিও অনেক কম ছিল। পরে আমরা হাসপাতালে অনেক চেষ্টা করেছি রিকভার করার জন্য। কিন্তু রিকভার করতে পারি নাই।’
উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল মোতালিব বলেন, ‘গরুটা দুই দিন ধরে অসুস্থ ছিল। এটার শরীরে অ্যান্টিবডি তেমন নাই। ওরা হয়তো পচা-বাসি খাবার খাওয়াইছে। আবার ফিডও খাওয়াইছে মনে হয়। ওরাও বলছে, ফিড খাওয়াইছে।
‘দানাদার খাবার বেশি খাওয়াইলে অনেক সময় পেট ফুলে যেতে পারে, গ্যাস হতে পারে। যার কারণে ফুড পয়জনিং হয়ে মারা গেছে। গরুটা মুমূর্ষু অবস্থায় আমাদের কাছে নিয়ে আসছে। আনার পরে আমরা যথার্থ চিকিৎসা যা দেয়ার দিয়েছি। কিন্তু চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয় নাই। তারপরে গরুটা মারা গেছে।’
এ ধরণের খর্বাকৃতি স্বল্প ইমিউনিটির গরুর যত্ন কেমন হওয়া উচিত, রানিকে সেভাবে রাখা হয়েছিল কি না- তা জানতে যোগাযোগ করা হয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামের সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, এ ধরনের গরু যেহেতু স্বাভাবিক না, সেহেতু এগুলোর যত্ন-আত্তিও অন্যসব গরুর মতো নেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি এ ধরনের গরুকে অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা জায়গাতেই রাখা দরকার।
সাজেদুল বলেন, ‘আমি প্রথম যখন রানিকে দেখতে সেখানে যাই, তখনই তাদের (খামার কর্তৃপক্ষ) বলেছিলাম এর যত্ন নিতে হবে বিশেষভাবে। তাদের জানিয়েছিলাম, স্বাভাবিক গরুকে যে পরিমাণ খাবার দেয়া হয়, রানিকে সে পরিমাণ দেয়া যাবে না। তার ওজন বুঝে পরিমিত খাবার দিতে হবে। যেহেতু এটি আকারে ছোট, তাই অন্য গরুর থেকে এটিকে আলাদা করে রাখতে হবে।’
রানির যত্নে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, জানতে চাইলে সাজেদুল বলেন, ‘এটি আমি বলতে পারব না। রানির বিষয়ে বিভিন্ন সময় খামার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে ফোন করে পরামর্শ নিতেন। রানিকে শেষ সময়ে যখন নিয়ে আসে, তখন পরীক্ষা করে বোঝা গেছে যে এটি অন্তত দুই দিন ধরে অসুস্থ।
‘যখন রানি অসুস্থ হয়, তখনই আমাদের খবর দেয়া উচিত ছিল। তাহলে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা দিলে হয়তো রানিকে বাঁচানো যেত।’
সাজেদুল মনে করেন, যে গরু নিয়ে দেশে-বিদেশে এত চর্চা হচ্ছে, তার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে খামার কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল।
রানির অসুস্থতার খবর কেন আগে জানানো হলো না, সেই প্রশ্নও তোলেন এই চিকিৎসক।
রানির মৃত্যুর পর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ রিপোর্টার জাহিদুর রহমান ফেসবুকে লেখেন, ‘আমরা আসলে কেমন? দেখেন একটা খর্বাকৃতির গরুর জন্য আমাদের কতই না উচ্ছ্বাস, উৎসাহ! গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠানো নিয়ে কথা! সেই খর্বাকৃতির গরুটা অসুস্থতা নিয়ে আজ মারা গেল। যেতেই পারে। জন্ম-মৃত্যু যেখানে সৃষ্টিকর্তার হাতে।
‘খামারের মালিক শিকড় অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. আবু সুফিয়ানকে ফোন দিলাম ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। তিনি বেমালুম অস্বীকার করলেন। বললেন, তার “রানি” মরেনি। বোঝেন অবস্থা! এই গরুটি তো আর কোটি টাকার ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা নয়। তো সেই গরুর মৃত্যুর খবর তিনি কেন অস্বীকার করছেন? কারণ একটাই। তার আকাঙ্ক্ষা, এই খবর কোনোমতে চেপে রাখলে দেড় মাস পর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাদের নাম উঠবে।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সুফিয়ান। তবে নিজের প্রতিক্রিয়া নিউজবাংলার প্রতিবেদককে ইনবক্স করেন।
তিনি বলেন, ‘রানিকে আবিষ্কারের পর থেকেই সব প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক বন্ধুগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা, চারিগ্রাম এলাকার সর্বস্তরের জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় রানি। অনেক শৌখিন ক্রেতা উচ্চমূল্যে রানিকে কিনেও নিতে চান।
‘কিন্তু আমাদের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের হয়ে গিনেস বুকে আগে ওর নামটা লেখানো। তারপর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে শিকড় অ্যাগ্রোর পক্ষ থেকে উপহার দেয়া। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আবেদনও করে রেখেছিলাম… রানি তো রানি-ই। পৃথিবীর একমাত্র ইউনিক পিস। স্বাভাবিকভাবে সেলিব্রিটি হবার পর রানির নিরাপত্তার কারণে ওর চলাফেরা আমাদের সীমিত করতে হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে ছোট গরু আমাদের রানি মারা গেল।’
তিনি জানান, রানিকে ওই রাতেই খামারে মাটিচাপা দেয়া হয়।
রানির খবর গত ৫ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপরই দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয় ২০ ইঞ্চির এই গরুটি। দুই বছর বয়সী রানিকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে এএফপি, বিবিসি, অস্ট্রেলিয়ার এবিসি, ফ্রান্সের ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের গালফ নিউজসহ অনেক সংবাদমাধ্যম।
সে সময় বক্সার ভুট্টি জাতের এই গরুকে কিনতে আগ্রহ দেখান শৌখিন ক্রেতা ও খামারমালিকরা। এর জন্য সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতেও রাজি ছিলেন কেউ কেউ। তবে খামার কর্তৃপক্ষ গিনেস বুকে নাম ওঠার আগে রানিকে হাতছাড়া করতে নারাজ ছিলেন সে সময়।
শেষমেশ চিরতরেই হাতছাড়া হয়ে গেল রানি।