মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিব রওনক মাহমুদের করোনা আক্রান্ত মায়ের দেখভালের জন্য যে ২২ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের হাসপাতালে করোনা ইউনিটে ঢোকারই অনুমতি থাকার কথা নয়।
করোনা ইউনিটে চিকিৎসক ও সেবিকা ছাড়া কেবল স্বজনদের পাশে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। তাও সেখানে থাকে নানা বিধিনিষেধ।
সচিবের ৯৫ বছর বয়সী মা করোনায় আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলছে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে। সোমবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশ হয় যে, তার চিকিৎসার দেখভালের জন্য সময় বেঁধে দিয়ে ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রচারের পর তোলপাড় পড়ে যায়।
পরদিন মন্ত্রণালয়ে আসেননি সচিব। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক যোগ দিলেও বেলা ৩টা পর্যন্ত আর দপ্তরে যাননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের ফিরতে হয় নিরাশ হয়ে।
সচিবের অনুপস্থিতিতে কথা বলেছেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তার পুরোটাই ‘সচিবের কাছ থেকে শোনা’। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন যে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেছেন, আনুষ্ঠানিক চিঠি না গেলেও একটি অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা গেছে।
তিনি বলেন, এর সঙ্গে সচিবের সংশ্লিষ্টতা ছিল, এমন নয়। কয়েকজন অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সচিবকে তুষ্ট করতে এ কাজ করেছেন।
তবে সেই কর্মকর্তা কারা, সেটি বলেননি তিনি।
তালিকায় যাদের নামে বিস্ময়
সচিবের মায়ের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে যাদের দায়িত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের কারও চিকিৎসা বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান থাকার কথা নয়।
তাদের মধ্যে চারজন বিজ্ঞানী, যাদের একজন আবার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। একজন আছেন উপসচিব। দুজন করে আছেন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা। আছে একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, অ্যানিমেল প্রোডাকশন অফিসারের নামও। আরও আছেন তিনজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, চারজন ট্রেইনি সহকারী এবং বাকি পাঁচজন অফিস সহায়ক।
সব মিলিয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২২ জন। তাদের মধ্যে একজন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে তিনটি শিফটে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তালিকায় সচিবের মায়ের পরিচর্যায় প্রতিদিন চার শিফটে দুজন করে কর্মীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিন দিনে দায়িত্ব পালন করার কথা ২৪ জনের। তবে প্রকৃতপক্ষে ২২ জনের নাম আছে। কারণ, একজন কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছি তিন শিফটের দায়িত্ব।
আসাদুল আলম নামে সেই কর্মকর্তা প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী তিনি সাইট ইনচার্জ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি আঞ্চলিক কেন্দ্রে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন।
বণ্টন করা সূচি অনুযায়ী তার সোম থেকে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা। এ সময়ে তার সরকারি দায়িত্ব কীভাবে পালন হয়েছে- এই বিষয়ে জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বহুবার কল করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় জবাব মেলেনি।
তার মতোই বিজ্ঞানী আছেন আরও তিনজন। তারা হলেন মৎস্য অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারুক মিয়া ও এম এস নিয়াজ মোর্শেদ।
তালিকায় তাদের রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে। একজনের সোমবার, একজনের মঙ্গলবার আর একজনের বুধবার।
সচিবের মায়ের চিকিৎসার দেখভাল করতে এভাবে সূচি করে দেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে
তালিকায় আছে প্রোগ্রামার নুর মোহাম্মদের নাম। যার দায়িত্ব পালনের কথা মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। সিস্টেম অ্যানালিস্ট ইলিয়াস হোসেনের দায়িত্ব পালনের কথা লেখা আছে সোমবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
মৎস্য অধিদপ্তরের যে দুই পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কর্মকর্তার নাম আছে, তাদের মধ্যে রাশেদ পারভেজের দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ আছে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। শামসুল আলম পাটওয়ারীর দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
ফোন করা হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এমন কোনো দায়িত্ব আমি পাইনি।’
একজন উপসচিবের নামও আছে তালিকায়। পুলকেশ মণ্ডল নামের সেই কর্মকর্তাকে বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে সেই তালিকায়।
অ্যানিমেল প্রোডাকশন অফিসার আলী রেজা আহম্মেদের সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ আছে।
তিনি কী দায়িত্ব পালন করেছেন- এই বিষয়ে জানতে তাকে ফোন দেয়া হলে বলেন, ‘আমি বাসে আছি, কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আপনি আমাকে পরে ফোন দেন।’
তবে এ কথা বলার আগে ‘আপনি কি আলী রেজা আহম্মেদ বলছেন?’ এমন প্রশ্ন তিনি শুনতে পেয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, বলুন।’
বাকিরা কেউ কর্মকর্তা নন। এই ২১ জনেরই নাম, পদবি এমনকি মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ থাকা বলে দেয়, তালিকাটি একটি অফিস থেকেই এসেছে।
মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের মুখে কুলুপ
মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি নিয়ে পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। কিন্তু বিষয় শুনেই তারা এড়িয়ে গেলেন।
সেই তালিকায় উল্লেখ আছে, তালিকাভুক্ত কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমন্বয় করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব আজিজুল ইসলামের সঙ্গে।
তবে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
কিন্তু এই কর্মকর্তা দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে সচিবের মায়ের সবশেষ খবর হোয়াটস অ্যাপে জানাতে বারবার তাগাদা দিয়েছেন বলে তথ্য মিলেছে।
যদি কিছুই না জানেন, তাহলে এই বিষয়টি কীভাবে ঘটল? এমন প্রশ্নে উপসচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সচিব স্যার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। এরপর আমার বলার কিছু থাকে না।’
একজন উপসচিবের কাছ থেকে যা জানা গেল
একের পর এক কর্মকর্তা এড়িয়ে যাওয়ার পর উপসচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে তথ্য জানাতে রাজি হলেন। তিনি বলেন, ‘সচিব স্যার কদিন আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ফলে ওনার শারীরিক অবস্থাটা ভালো না। এর মধ্যে মায়ের অসুস্থতা। আমার মনে হয়, কিছু উৎসাহী কর্মকর্তা এটা করেছে। কিন্তু বিষয়টা যেভাবে সংবাদে এসেছে, তেমন কিছু নয়। এটা অফিশিয়াল কোনো নির্দেশনা নয়।’
মন্ত্রণালয়ের সচিবের দেখা না পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মন্ত্রী-সচিবদের আপনজন সিক হলে অনেকেই দেখতে যান। সচিব স্যারের মা অসুস্থ হওয়ায় অনেকে দেখতে যাচ্ছিলেন। যেহেতু করোনা, তাই হয়তো ধাপে ধাপে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। তবে এটা অফিশিয়াল কোনো আদেশ ছিল না।’
সচিবের ঘনিষ্ঠ অপর এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তালিকা একটা হয়েছে। আমি নিজেও দেখেছি। তবে এটুকু বলতে পারি, ওটা কোনো অফিস আদেশ ছিল না, সিম্পলি একটা তালিকা।’
তবে কার বা কাদের নির্দেশে এই তালিকা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন তারা।
আরেকজন কর্মকর্তা বললেন, ‘তালিকাটি কে বা কারা করেছে বা কে ফাঁস করেছে, তা নিয়ে মন্ত্রণালয়জুড়েই আলোচনা চলছে।’
মন্ত্রী যা বললেন
সচিব মন্ত্রণালয়ে নেই। তবে ছিলেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ফলে তাকেই ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা।
তিনি বলেন, ‘আমি সচিবকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি বলেছেন যে এভাবে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কাউকে অফিশিয়াল কাজের বাইরে গিয়ে তার মাকে দেখভাল করা বা সেখানে কোনো দায়িত্ব পালনের কথা বলেননি।’
সচিবের মাকে এতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেখতে যাওয়া অতি উৎসাহী কাজ কি না, এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘এর বাইরে তো আমার বলার কিছু নেই। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি, এটা আমি নিশ্চিত হয়েছি। সচিবকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনিও বলেছেন, না, আমি ভারবালিও কাউকে কোনো দায়িত্ব দিইনি। কাউকে কোনোভাবে আমার মাকে দেখভালের দায়িত্ব দিইনি। এখন আমার মা অসুস্থ, তাকে সহানুভূতি জানাতে হয়তো কেউ যেতে পারেন।’
সচিব কী বলেছেন- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘গেছেন এটা উনি ওভাবে বলেননি, এভাবে কেউ যেতে পারেন, সেটা নিজ দায়দায়িত্বে যদি কেউ গিয়ে থাকে। লিখিত বা মৌখিকভাবে ওনার মাকে দেখার জন্য বা হসপিটালে যাওয়ার জন্য কিছু বলেননি। এটা উনি আমাকে জানিয়েছেন।’
হাসপাতাল পরিচালকও কিছু বলছেন না
সচিবের মা যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার পরিচালক মীর জামাল উদ্দিন দাবি করেছেন, তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে শুনেছি। যে কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না।’