প্রতারণার দায়ে আলোচিত ই-কমার্স সাইট ই-অরেঞ্জ ডট শপ কর্তৃপক্ষ লোভনীয় অফারের টোপ ফেলেছিল গ্রাহকের সামনে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতিষ্ঠানটি মূলত ১২ ক্যাটাগরিতে নানান পণ্য বিক্রির ব্যবসা চালাত। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ টাকা হাতিয়ে নেয়ার মূল অস্ত্র ছিল তাদের ‘ডাবল টাকা ভাউচার’ অফার।
এর মাধ্যমে মাত্র ১৫-৩০ দিনের মধ্যে গ্রাহকের এক লাখ টাকা পরিণত হতো দুই লাখ টাকায়, তবে মেয়াদ পূর্তির পরেও গ্রাহককে সেই টাকা ভোগ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। এর আগেই ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ‘লাভের ওপর লাভ’ এমন টোপ ফেলে হাজির হতো আরেকটি পণ্য বিক্রির লোভনীয় অফার নিয়ে।
এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল, স্কুটি, স্মার্টফোন, ফিচারফোনসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় পণ্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৬০-৭০ শতাংশ কম দামে বিক্রির ঘোষণা আসত। আর সেই ছাড়ের সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন গ্রাহক।
এভাবে সবশেষ চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পাঁচ মাসে ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে খোয়া গেছে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা। ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে করা মামলার বাদী মো. তাহেরুল ইসলামসহ ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন গ্রাহক নিউজবাংলার কাছে এমন অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, ই-অরেঞ্জ দিত ‘সামার ভাউচার’ এবং ‘স্বপ্ন ভাউচার’ অফার। এর আওতায় কেনা প্রতিটি ভাউচার ন্যূনতম একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে (৭-১৫ অথবা ১৫-৩০ দিনে) দ্বিগুণ হয়ে যেত। অর্থাৎ নগদ টাকা আগাম জমা করে যে কেউ এক লাখ টাকার (বিভিন্ন রেটের ভাউচার) কোনো একটি ভাউচার কিনলে তা দিয়ে দুই লাখ টাকার পণ্য কেনার সুবিধাভোগী হতেন।
প্রতারণার অভিযোগ করা গ্রাহকেরা বলছেন, প্রায় এক লাখ গ্রাহকের এখন যে ১১০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে, তার বেশির ভাগই ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা হয়েছে এই ভাউচার অফারের আওতায়। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন হিসাবে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন স্তরের গ্রাহক অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে এই টাকা জমা করেছিলেন।
‘সামার’ ও ‘স্বপ্ন’ ভাউচারের বেশির ভাগ গ্রাহক মেয়াদ পূর্তির পরও তাদের পুঁজিসহ লাভের টাকা ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাব থেকে নিজেদের হিসাবে স্থানান্তর করতে পারেননি, অথবা তা দিয়ে কোনো পণ্য কিনতে পারেননি। কারণ সেই টাকা গ্রাহকের হিসাবে লাভসহ হস্তান্তরের আগেই ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ আরেকটি টোপ ফেলেছে গ্রাহকের সামনে।
তাদের বলা হয়েছে, ‘বাইকিং অ্যান্ড রাইডিং’ নামে নতুন একটি অফার আসছে। এর আওতায় সেখানে ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্টে থাকছে মাত্র ১০ কর্মদিবসে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল কেনার সুযোগ। এ ক্ষেত্রে নতুন করে প্রলুব্ধ হয়েছেন গ্রাহক।
এ ধরনের ব্যবসায়িক ফাঁদ নিয়ে ইলেকট্রনিক কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল নিউজবাংলাকে জানান, ‘ই-অরেঞ্জের ডাবল টাকা ভাউচারের অফার কোনো বিজনেস মডেল হতে পারে না।’
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এক লাখ টাকা কী করে মাত্র ১৫-৩০ দিনের ব্যবধানে দুই লাখ টাকা হয়! এ ধরনের অফার ব্যবসাবহির্ভূত এবং ই-কমার্স খাতের জন্য ক্ষতিকর। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে গত বছরই ইভ্যালির পাশাপাশি ই-অরেঞ্জসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের অফারের বিষয়ে জানিয়েছিলাম। তার আলোকেই কিন্তু ই-কমার্স পরিচালনসংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি হয়েছে। তবে তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল তাদের ব্যাংক হিসাবে ভাউচার বিক্রির মাধ্যমে জমা হওয়া গ্রাহকের সব টাকা প্রতারণার মাধ্যমে ধরে রাখতে এবং পরে সময়-সুযোগ বুঝে তা উঠিয়ে নিতে।
দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্টে মোটরসাইকেল অফার দেয়ার প্রথম ১৫ দিনেই ডাবল টাকা ভাউচারের প্রায় ৮০ শতাংশ মালিক তাদের মূল পুঁজি ও লাভের টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনতে নিজেদের নাম নিবন্ধন করিয়েছেন।
এ ছাড়া ই-অরেঞ্জে ডাবল টাকা ভাউচারে লেনদেন না করা অসংখ্য ক্রেতাও বাইকিং অ্যান্ড রাইডিং অফারের আওতায় মোটরসাইকেল, স্কুটি ও মোটর কার কেনার জন্য অনলাইনে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেছেন কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাবে। কেউ কেউ আবার এসব যন্ত্রযানের এক্সেসরিজ কেনার জন্যও আগাম টাকা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এই অফারের আওতায় আরও প্রায় ১১০ কোটি টাকা জমা হয়েছে ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে। তবে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কেউ-ই পণ্য বুঝে পাননি।
এর ফলে প্রায় ৭৭৩ কোটি টাকার দাবি রয়েছে শুধু ডাবল টাকা ভাউচার মালিক এবং ভাউচারে লেনদেন না করে সরাসরি অগ্রিম দিয়েছেন এমন গ্রাহকের।
আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট মূল্যে মোবাইল অ্যান্ড গেজেট অফারের আওতায়ও স্মার্টফোন ও ফিচারফোন বিক্রির অফার দিয়েছিল ই-অরেঞ্জ। ভেন্ডর হিসেবে ছিল আইফোন, নকিয়া, শাওমি, সিম্ফনি, ম্যাক্সিমাস, হুয়াওয়ে, রিয়েলমি, ইনফিনিক্স, ব্ল্যাকবেরি, ভিভো, অপপো, ওয়ালটন, স্যামসাং, পোকো, রিডমি, ওয়ানপ্লাস ও মটরোলা। টাকা পাওয়া সাপেক্ষ এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অনুকূলে মোবাইল ফোন সরবরাহ করত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এসব স্মার্টফোন ও ফিচারফোন কেনারও নিবন্ধন করেছিলেন ডাবল টাকা ভাউচার অফারের বেশ কিছু গ্রাহক। পাশাপাশি ভাউচারবহির্ভূত কিছু গ্রাহকও ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে টাকা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মোবাইল অ্যান্ড গেজেট অফারের আওতায়ও জমা হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকার মতো। তবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে কোনো গ্রাহকই টাকা দিয়ে তার পণ্য বুঝে পাননি।
১১০০ কোটি টাকার দাবিদারদের মধ্যে বাকি গ্রাহকরা লেনদেন করেছেন ইলেকট্রনিকস, হোম অ্যান্ড লিভিং, স্পোর্টস অ্যান্ড আউটডোর, ডিজিটাল সেবা, উইন্টার হান্টার, ওমেন্স ক্লাব, ওমেন্স ওয়ার্ল্ড, কিডস জোন, হেলথ অ্যান্ড বিউটি ক্যাটাগরির বিভিন্ন অফার করা পণ্যে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশে ডিজিটিাল ই-কমার্স সেলের প্রধান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রাহকের পাওনা কত কিংবা ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের দায় কত সেটি এখনও সুনির্দিষ্ট নয়। পরিমাণ তো গ্রাহকের দাবির চেয়ে আরও বেশিও হতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার বিষয় আছে।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের পাওনা ১১০০ কোটি টাকা ফেরত পেতে সহযোগিতা চেয়েছেন। তারা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সামনাসামনি বসে আলোচনা চান। একইভাবে পাওনা পরিশোধে সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখের লিখিত প্রতিশ্রুতিও দাবি করেছেন। অভিযোগ পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রাহকের দায়-দেনা ও তাদের সম্পদের পরিমাণসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে চিঠি দেয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তার জবাব দিতে বলা হয়েছে।’
ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জানান, ‘আসলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের সংখ্যা কত এবং তাদের দাবির বিপরীতে মোট টাকার পরিমাণ কত সেটি নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাজ করার অনেক বিষয় আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) এ বিষয়ে তদন্ত ও অধিকতর তদন্তের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুরোধ করতে পারে।’
ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রাহকের মামলায় মালিক-কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। ঢাকার আজমপুরের বাসিন্দা মো. তাহেরুল ইসলাম ১৯ জুলাই রাতে ৩৭ জন গ্রাহকের পক্ষে গুলশান থানায় মামলাটি করেন।
আসামিরা হলেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান, চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরী, বিথী আক্তার, কাওসার ও ই-অরেঞ্জের সব মালিক। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে কতজন মালিক রয়েছেন তা এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।
তাহেরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের অফারের আওতায় আট লাখ টাকার ভাউচার কিনেছিলাম। সেই ভাউচার মেয়াদপূর্তির পর ১৬ লাখ টাকা হয়। আমার আইডি নম্বরের অনুকূলে প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে আরও ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ মোট ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাই। এর মধ্যে এই ভাউচারের টাকায় আমি একাধিক মোটরসাইকেল কেনার জন্য নাম এন্ট্রি করি। তবে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে মোটরসাইকেল পাওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত পাইনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ শুধু আমার সঙ্গে নয়, এমন প্রায় এক লাখ গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’
রাহাত হোসেন খান নামে এক গ্রাহক জানান, ই-অরেঞ্জের অর্ডারের প্রায় ৯০ শতাংশই বাইক, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন বাইক সরবরাহ করছে না। নতুন করে আরও ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় চাচ্ছে। আর এখন মালিকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এপ্রিলে সামার ভাউচার কিনেছি, এখন আগস্ট চলে যাচ্ছে। তারা বলছে আরও দুই মাস সময় লাগবে, অথচ ৪৫ দিনের মধ্যেই পণ্য দেয়ার কথা ছিল।’
মো. সবুজ নামের আরেকজন বলেন, ‘শুরু থেকেই ই-অরেঞ্জ বিভিন্ন ভাউচারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকার ভাউচার কিনলে ২ লাখ টাকার পণ্য কেনার সুবিধা দেয়া হয়।
‘সবশেষ এই বছর করোনার কারণে দেয়া শাটডাউনের আগে সামার ভাউচারের মাধ্যমে তারা ক্যাম্পেইন চালায়। এতে অনেক গ্রাহক পণ্যের অর্ডার করেন। যার বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন ধরনের মোটরসাইকেল। তবে তারপর থেকেই পণ্য সরবরাহ বন্ধ।’
সবুজ বলেন, ‘ই-অরেঞ্জ বলেছিল এই অর্ডারের পণ্যগুলো ঈদের আগে যে পাঁচ কার্যদিবস শটডাউন শিথিল করা হচ্ছিল তখন সরবরাহ করবে, কিন্তু করেনি। এরপর আরও তিন দফা তারিখ দেয়া হলেও তারা পণ্য সরবরাহ করছে না। আর এখন বলছে তারা বাইক দিতে পারবে না।’