দেশে করোনার সময়ে মানসিক বিষণ্নতায় ভোগা তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা বেড়েছে। করোনা মহামারির সময় প্রায় ৬১ শতাংশ তরুণ বয়সী মানসিক বিপর্যয়ে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে পরিচালিত করছে।
তরুণদের সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক শিরোনামে এ জরিপ চালানো হয় ২০২১ সালের ১ জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত। উদ্দেশ্য, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণগুলো চিহ্নিত করা ও তা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা এবং সকলকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা।
শনিবার সকালে আঁচল ফাউন্ডেশনের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এ সময় আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
আঁচল ফাউন্ডেশ জানায়, গত মার্চ মাসে তারা করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার হার সংক্রান্ত একটি জরিপ পরিচালিত করে। সেখানে তারা দেখতে পায়, আত্মহননকারীদের প্রায় ৪৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
ফলে তরুণ বয়সীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার কারণ খুঁজতে এ জরিপ পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন।
জরিপে মোট ২ হাজার ২৬ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের সবচেয়ে বড় অংশ ১ হাজার ৭২০ জন ছিলেন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী। এ ছাড়া এতে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২৪৩ জন অংশ নেন। ৩১- ৩৫ বছর বয়সী ছিলেন ৬৩ জন। মোট অংশগ্রহণকারী নারী ১ হাজার ২৯৩ জন বা ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার ছিলেন শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, ৫০ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ-তরুণী মানসিক চাপে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন। এদের মধ্যে করোনার সময়ে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন, তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন নি। ৮ দশমিক ৩ শতাংশের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে, তারা আত্মহত্যার উপকরণ প্রস্তুত করেছেন, কিন্ত শেষে পিছিয়ে এসেছেন। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান বলেন, দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের ঘুম কম হচ্ছে, বিষণ্ণতা ও হতাশা বাড়ছে, আত্মহত্যার হারও বাড়ছে।
করোনার সময়ে তরুণ-তরুণীরা প্রধাণত যে ধরণের মানসিক চাপজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা হলো: ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী হয়ে যাওয়া, অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, সেশন জট, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ইত্যাদি।
জরিপে অংশ নেয়া ৬১ দশমিক ২ শতাংশ (১ হাজার ২৩৯ জন) বলেছেন, তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন। ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ (৭৮৭ জন) বলেছেন, তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন না। ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ তাদের বিষণ্নতার কথা কাছের মানুষদের কাছে শেয়ার করতে পারলেও ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ জানান, তারা তাদের বিষন্নতা বা মানসিক অস্থিরতা শেয়ার করার জন্য কাউকেই পাশে পান না।
জরিপে দেখা যায়, ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ বলেছেন, তাদের পরিমিত (ছয় থেকে আট ঘণ্টা) ঘুম হয়। ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীরই পরিমিত ঘুম হয় না, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
জরিপে দেখা যায়, মোট ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী বলছেন, করোনাকালীন তাদের মানসিক চাপ আগের থেকে বেড়েছে। এদের মধ্য ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন, এই চাপ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। আবার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ বলছেন, এই চাপ করোনাকালীন সামান্য বেশি। ১৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন, চাপ আগের মতোই আছে। বাকি ১৮.৪ শতাংশ বলছেন, তাদের মানসিক চাপ আগের থেকে কমেছে ।
সাধারণত মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এ ধরণের মানসিক অসুস্থতা অনেকটা সমাধান করা সম্ভব। জরিপের ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ এ ব্যাপারে জানলেও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী কখনও কোনো বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন নি।
জরিপের বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘যারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শুধু তাদেরকে কাউন্সেলিং দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। বরং একজন তরুণ বা তরুণী কেন আত্মহত্যাপ্রবণ বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন, তার কারণ বের করে সমাধান করে সমস্যার মূলোৎপাটন করতে হবে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের আয় কমে আসছে। অনেকে নিজের ব্যবসা হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এ কারণে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। তবে রোগী বাড়লেও চিকিৎসার বাইরে থাকছেন অনেকে।
ইনস্টিটিউটের আরেক অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। মানসিক চাপ হ্রাস করতে হবে। ঘুমের চক্র স্বাভাবিক রাখতে হবে। নিজের পছন্দের বিষয় ও কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া পরিবারের সঙ্গে ঘরের মাঝেই এক সঙ্গে সময় কাটানো ও পছন্দের কাজ করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কিছু সময় অবশ্যই শারীরিক ব্যয়াম করতে হবে। সর্বোপরি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে আছি, বেঁচে আছি এ জন্য সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অথবা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা যায় বলে জানান অধ্যাপক মেখলা সরকার।