বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অ্যাডমিন অ্যাসোসিয়েশন কি এই বিবৃতি দিতে পারে

  •    
  • ২১ আগস্ট, ২০২১ ২৩:৩৯

‘সেনাবাহিনীতে যদি কখনও কেউ অ্যাগ্রিভড (সংক্ষুব্ধ) হয়, সে কি পত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারবে? কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারবে না। তারা তাদের বিভাগীয় সিস্টেমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের যে মর্মবেদনা যেভাবে লেখা আছে, তাদের আইনে তা জানাবে। সিভিল সার্ভিসেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত ছিল।’

বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে গত দুই দিন ধরে তুমুল আলোচনা চলছে।

নিউজবাংলা কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে, যাদের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, একজন লোকপ্রশাসন এবং একজন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক।

ঘটনাটি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা থাকলেও তিনজনই একমত যে, এ ধরনের বিবৃতি আসা কাম্য ছিল না প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বিবৃতির মতো হয়ে গেছে এটি। কিন্তু যারা প্রশাসন চালাবেন, তারা আগেভাগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন না। আবার রাজনৈতিক নেতাদের মতো বহুল প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করে কাউকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করাও উচিত নয়।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এই ঘটনাটি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বরিশালের ঘটনাটি তিনি জানেন। প্রশাসনের বিবৃতিও পড়েছেন তিনি।

এ ধরনের বিবৃতি আর বিবৃতিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি যুক্তিসংগত কি না, এমন প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই।’

এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, চলছে তদন্ত। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘ব্যবস্থা নেয়া হবে’ উল্লেখ করে যে কথা বলা হয়েছে, তা তাদের কর্মপরিধির মধ্যে পড়ে না বলে মনে করেন প্রশাসন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই তিন অধ্যাপক।

প্রশাসনের এই বিবৃতি স্পষ্টতই বরিশালে রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন তুলেছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানালেও বরিশালে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা নানাভাবে তাদের অসন্তোষ জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন মনে করেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে অথবা সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী এ ধরনের বিবৃতি তারা দিতেই পারেন না।

তিনি সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সেখানে যদি কখনও কেউ অ্যাগ্রিভড (সংক্ষুব্ধ) হয়, সে কি পত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারবে? কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারবে না। তারা তাদের বিভাগীয় সিস্টেমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের যে মর্মবেদনা যেভাবে লেখা আছে, তাদের আইনে তা জানাবে। সিভিল সার্ভিসেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত ছিল।’

আখতার হোসেন বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন চাকরি করি, সেখানেও অনেক বিধিবিধান আছে। সেই অনুযায়ী আমার কাজ করা উচিত।

‘আমি স্ট্রেইট বলতে চাই, তাদের সার্ভিস রুল যদি এটা পারমিট না করে, আমি সেটা শিওর না, তবে তারা এভাবে পাবলিকলি স্টেটমেন্ট দিতে পারে না। এটা কখনোই কাম্য নয়। এটা ডিসিপ্লনের পরিপন্থি।’

এ বিষয়টি প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে কি না, তা নিয়েও দুর্ভাবনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। তার মতে, এতে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়, যা একটি রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।

তিনি বলেন, ‘কোনো মানুষের যদি অধিকার খর্ব হয় বা কোনো ধরনের সমস্যা থাকে, তার প্রতিকার চাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সেই প্রতিকার চাওয়ার প্রত্যেকের আলাদা ব্যবস্থা আছে। সেই মতেই সবার চলা উচিত। এর বাইরে যদি চলে যায়, তাহলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয় আর রাষ্ট্রের যে আল্টিমেট কাঠামো সেটাতে ব্যাঘাত ঘটে।

‘এভাবে হলে সার্ভিসের ডিসিপ্লিন নষ্ট হয়ে যায়। সরকার ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নষ্ট হয়ে যায়।’

রাজনীতি-প্রশাসনকে মুখোমুখি দাঁড় করাবে

এমন বিবৃতির ফলে রাজনীতি ও প্রশাসন একটা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউননেছা।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনাগুলোর জন্য সরকার একটু বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। ঘটনা ঘটার পর দুই পক্ষের উচিত ছিল তাদের দোষগুলো স্বীকার করে নিয়ে তা সমাধান করা।

‘সরকার চেষ্টা করে রাজনীতির সঙ্গে প্রশাসনের সুন্দর একটা সম্পর্ক বজায় রাখার। প্রশাসনের মানুষ আমাদের নিজেদের মানুষ। তাই বাসায় হামলা করা, ঝামেলা সৃষ্টি না করে যদি কোনো ভুল থাকত, সেটাকে সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারত।’

এই অধ্যাপক মনে করেন, রাজনীতিবিদদের প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত আবার প্রশাসনেরও রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত। আমাদের মধ্যে যদি সম্মানবোধ না থাকে, তাহলে কিন্তু এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝেই পড়তে হতে পারে।

‘রাজনৈতিক বিবৃতি মনে হয়েছে’

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠন থেকে এ ধরনের বক্তব্য কখনোই আশা করেন না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ এস এম ফিরোজ উল হাসান।

তিনি বলেন, ‘এটি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত যে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে এত দ্রুত এবং এ রকম ভাষায় একটা বিবৃতি আসবে। এটা আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বা প্রশাসনের ইতিহাসে কোনো শুভ ইঙ্গিত নয়।

তিনি বলেন, ‘ওখানে যিনি মেয়র আছেন, তার সম্পর্কে বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে, সেটি কাম্য নয়। তাদের উচিত ছিল তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিচারের ব্যবস্থায় আনার কথা বলা, যদি তারা বিবৃতি দিয়েও থাকে। কিন্তু ওনারা তদন্তের আগেই চিহ্নিত করে ও নাম উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছেন।’

ফিরোজ উল হাসান মনে করেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের যে মর্যাদা, তার সঙ্গেও এটি সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক দলের বিবৃতির মতো হয়েছে। তাদের (অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যায় না।’

তিনি বলেন, ‘সেখানে কিন্তু মামলা হয়েছে। বিচারব্যবস্থা আছে। সুতরাং বিচার-প্রক্রিয়ার আগেই তারা একজনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছে এবং প্রকাশ্যে। এটা আসলে খুবই অনভিপ্রেত।

‘এটি আমলা ও রাজনীতিবিদদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং দেশের রাজনীতির জন্য, একই সঙ্গে আমলাদের জন্য ইতিবাচক নয়।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনা খুবই ছোট ছিল। বরিশালের যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, আবার যারা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে আছেন, তারা বসে কিন্তু অল্প সময়ে এটা সমাধান করতে পারতেন। সেটি না করে বা তার পরে যেটি হয়েছে, সেটি ইতিবাচক নয়।’

যা ঘটেছিল

গত বুধবার রাতে ব্যানার অপসারণ নিয়ে বরিশাল সদরের ইউএনও মু‌নিবুর রহমানের সঙ্গে সি‌টি করপোরেশনের প্রশাস‌নিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কথা-কাটাকা‌টি হয়।

প্রশাস‌নিক কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ সময় ইউএনওর সঙ্গে বিবাদে জ‌ড়িয়ে পড়েন।

এ সময় আনসার‌ সদস্যদের সঙ্গে হাতাহা‌তি শুরু হলে আওয়ামী লী‌গ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ইউএনওর বাসায় হামলার চেষ্টা চালান। আনসার সদস্যরা গু‌লি ছুড়লে প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসসহ চারজন আহত হন।

সংঘর্ষের পর সদর ইউএনওর কার্যালয়ের সামনে পুলিশ অবস্থান নিলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আবার ইউএনওর বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন। এ সময় পু‌লিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

যা ছিল সেই বিবৃতিতে

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর গ্রেপ্তার দাবি করা হয়।

বিবৃতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও তার অনুসারীদের ‘দুর্বৃত্ত বাহিনী’উল্লেখ করা হয়েছে, মেয়রকে ‘অত্যাচারী’ বলা হয়েছে।

বিবৃতিটি ছিল এমন: ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করা হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বরিশালের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কীভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা হেনস্তা হয়েছেন। তার বাসায় হামলা করা হয়, যেখানে তার করোনা আক্রান্ত অসুস্থ বাবা-মা ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই ওই কর্মকর্তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে। তার বাড়ির গেট ভেঙে প্রবেশ করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তার চামড়া তুলে নেয়ার জন্য প্রকাশ্যে স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে দুর্বৃত্তরা।’

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও তার ‘দুর্বৃত্ত বাহিনী’ সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। তারা পুরো জেলায় ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মেয়রের অত্যাচারে বরিশালবাসী অতিষ্ঠ। মেয়রের হুকুমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে। অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার দাবি করছে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।’

এ বিভাগের আরো খবর