১৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যে বিভীষিকা নেমে এসেছিল, তার ১৪ বছর পর বিচারিক আদালত থেকে যে রায় এসেছে, সেটি উচ্চ আদালতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে দ্রুত কার্যকর হবে বলে আশা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বলেছেন, এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ১৭ বছর পূর্তির আগের দিন দেয়া এক বাণীতে সরকার প্রধান এই আশা করেন।
সেই হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা, যিনি সে সময় ছিলেন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা। তাকে মানববর্ম বানিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন নেতারা। স্প্লিন্টার নিজের গায়ে বিদ্ধ করে নেত্রীর জীবন বাঁচাতে পারলেও নিজের প্রাণ ঝরে যায় বহুজনের।
এই হামলার বিচার পেতেও কম জল নষ্ট হয়নি। সে সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ইচ্ছা করেই বিচারকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার যে চেষ্টা করেছিল, তা পরে প্রমাণ হয়ে যায়।
পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে একবার আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর আবার হয় তদন্ত।
হামলার ১৪ বছর পর ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত থেকে আসে রায়। আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় রায়ে। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং ১১ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
তবে সাজা কার্যকরে এখনও অনেক সময় বাকি। মৃত্যুদণ্ডের সাজা উচ্চ আদালতে অনুমোদন হতে হবে। কিন্তু প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। শুনানি হয়নি একটি দিনও।
প্রধানমন্ত্রী আশা করছেন, বিচারের এই প্রক্রিয়া গতি পাবে। তিনি বলেন, ‘আশা করি, সকল আইনি বিধি-বিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যত দ্রুত সম্ভব ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রায় কার্যকর হবে। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে এবং বাংলাদেশ আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ-শান্তিপূর্ণ আবাসভূমিতে পরিণত হবে।’
হামলা বিএনপি জামায়াত জোটের পৃষ্ঠপোষকতায়
২১ আগস্টকে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন হিসেবে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘২০০৪ সালের এ দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
‘এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে হত্যা, ষড়যন্ত্র, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে চিরস্থায়ী করা।’
তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহ’র অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেন। তবে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী বেগম আইভি রহমান-সহ ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তাকর্মী। তাঁদের অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এবং অনেকে দেহে স্প্লিন্টার নিয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন।’
বিএনপি-জামায়াত জোট যখনই সরকারে এসেছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। একের পর এক বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়।’
তদন্তের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যা হয়েছিল, তারও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো হত্যাকারীদের রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা করেছিল। হামলাকারীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত ধ্বংস করে। তদন্তের নামে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে।
“রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে তারা জনগণকে ধোঁকা দিতে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায়। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকেনি। পরবর্তীকালে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে বেরিয়ে আসে বিএনপি-জামায়াত জোটের অনেক কুশীলব এ হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।”
রায়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে
বিচারিক আদালতের দেয়া রায় তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আদালত গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
‘একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে পলাতক তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ণ্ড হয়েছে ১১ আসামির। এই রায়ের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।’
স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিরোধী চক্র এখনও নানাভাবে সোচ্চার আছে বলেও সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এই অপশক্তির যে কোনো অপতৎপরতা-ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।’
প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত সাড়ে ১২ বছরে দেশের প্রতিটি সেক্টরে কাঙ্খিত অগ্রগতি অর্জন হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ‘রোল মডেল’। আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এই সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। বর্তমান প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মহামারির মধ্যেও আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’