১৬ বছর আগের সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা দেশবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক যে বহুদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে, এ ঘটনার পর সে বিষয়ে সকল সংশয়ের অবসান হয়েছিল।
সেদিন ৬৪ জেলার মধ্যে কেবল বাদ পড়েছিল মুন্সীগঞ্জ জেলা। বাকি ৬৩ জেলার ৫০০টি স্থানে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
একযোগে বোমা হামলার ওই ঘটনায় দুই জন নিহত হন আর আহত হন অন্তত ১০৪ জন। এই বোমা হামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়।
বিচারকাজ কতদূর?
সিরিজ বোমা হামলার ১৫৯ মামলার মধ্যে ঢাকায় ৪১টি, চট্টগ্রামে ১৯টি, রাজশাহীতে ১১টি, খুলনায় ২৬টি, বরিশালে ১৯টি, সিলেটে ২৬টি, রংপুর আটটি, ময়মনসিংহে ছয়টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। বাকি তিনটি মামলা রেলওয়ে পুলিশ দায়ের করে।
পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাব বলছে, আদালতে বিচারকাজ শেষ হয়েছে ৯৭টি মামলার। বিচারাধীন রয়েছে আরো ৪৬টি মামলা। বাকি ১৬টি মামলার তদন্ত শেষে ফাইনাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেছে পুলিশ।
মামলাগুলোর বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঠিক সময়ে সাক্ষীদের না পাওয়ায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সময়ে শুনানিতে সাক্ষীরা অনুপস্থিত থাকতেন।
‘সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য অনেকবার আদালত নতুন তারিখ দিয়েছেন। এতো জটিলতার পরও অধিকারংশ মামলার বিচার হয়ে গেছে। যেগুলো বাকি আছে, সেগুলো আবার করোনা মহামারির জন্য আটকে আছে। আশা করি মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলে মামলাগুলোর কাজ শেষ হয়ে যাবে।
জেএমবির শুরু যেভাবে১৯৯৮ সালে গঠিত হয় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন শায়খ আবদুর রহমান।
এ সংগঠন বাংলাদেশকে ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে তাদের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে। এরপর দাওয়াত ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে শুরু হয় তাদের সংগঠনের প্রচার।
প্রথম দুই বছর দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে জেএমবি।
২০০০ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ক্যাম্পে শুরু হয় জেএমবি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ছোট ছোট কয়েকটি নাশকতার ঘটনা ঘটালে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সংগঠন হিসেবে জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর পরই সিরিজ বোমা হামলার জন্য তারা দীর্ঘ পরিকল্পনা করে। আর এই হামলার মধ্য দিয়েই মূলত নিজেদের অস্তিত্ব ও সক্ষমতার জানান দেয় জঙ্গি সংগঠনটি।
জেএমবির বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান
২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটে সূর্য দীঘল বাড়ি নামে একটি বাসভবনে শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশন চালিয়ে জেএমবির আমি শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এর চারদিন পর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকা থেকে সংগঠনের আরেক শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইও ধরা পড়েন র্যাবের জালে।
এর আগে ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে জেএমবি। ২০০৬ সালের ২৯ মে এই হত্যা মামলার রায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ (ফারুক) ও আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।
২০০৭ সালের ২৯ মার্চ তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
শীর্ষ দুই নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের ফাঁসির মধ্য দিয়ে জেএমবির প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।
দুই নেতার বিদায়ের পর জেএমবির আমিরের দায়িত্ব পান হবিগঞ্জের সাইদুর রহমান। ২০১০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হলে জেএমবি দুভাগ হয়ে একটি গ্রুপ নব্য জেএমবি নামে আবির্ভূত হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজানে সেই নব্য জেএমবির সদস্যরা।
জঙ্গিদের সক্ষমতা কতটা?
বাংলাদেশে শুরুতে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও পরে জেএমবি জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ২০০৬ সাল থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় শক্তি হারাতে থাকে তারা। এরপরও একেবারে নিষ্ক্রীয় হয়নি জঙ্গিরা। সংগঠনের নাম বদলে বা বিভক্ত হয় নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এটিবি দেশে জঙ্গিবাদকে লালন করতে শুরু করে। এ সংগঠন দুটির তৎপরতা এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে কেউ কেউ মারা গেলেও আবার কিছুদিন পরপরই গ্রেপ্তার হচ্ছেন এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সবশেষ গ্রেপ্তার হন নব্য জেএমবির প্রধান বোমা কারিগর জাহিদ হাসান ওরফে ফোরকান ভাই।
একের পর এক জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনায় প্রশ্ন আসে, কতটা সুসংগঠিত এই সন্ত্রাসবাদিরা? প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক নজরদারিতে জঙ্গিদের কোনো বড় কিছু করার সক্ষমতা একবারেই নেই।
তিনি বলেন, ‘একের পর এক জঙ্গি ধরা পড়ছে মানেই হলো আমরা তাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছি। নজরদারি না থাকলেও তো তারা ধরা পড়ত না। আমরা ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে তাদের সাংগঠনিক শক্তিতে আঘাত হেনেছি। তাই তারা লুকিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করতেই পারে, তবে তারা সুসংগঠিত হতে পারবে না।’