বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের বিচার হলেও নেপথ্যের খলনায়কদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন করার দাবির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই হত্যার পেছনে কারা, তাদের পরিচয় প্রকাশ হবে।
সোমবার আওয়ামী লীগের জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার স্মরণে ক্ষমতাসীন দল এই আলোচনার আয়োজন করে।
জাতির পিতার কন্যা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা নেপথ্যে ছিলেন, তাদের পরিচয়ও বের হয়ে আসবে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ১৫ আগস্ট রাতের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা হত্যা করেছে, আর যারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে সবাই কিন্তু সমানভাবে দোষী।
‘আমি আরও অনেক ঘটনা জানি। হত্যার বিচার করাটা জরুরি ছিল। ধীরে ধীরে কারা জড়িত সেটাও বের হবে। সে দিন দূরে নয়।’
‘হত্যার গ্রাউন্ড তৈরিতে কারা?’
শেখ হাসিনা বক্তব্য দেয়ার আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা আছে বলে নানা যুক্তি দেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে আসলে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখার পরামর্শ দেন। বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুক্তিযুদ্ধের পর যখন ফিরে এলেন তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ। দেশ গড়ে তোলার কাজে হাত দিলেন।
‘আমার নিজের মনে কয়েকটি প্রশ্ন আসে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যেটি পাকিস্তানের প্রদেশ ছিল। দারিদ্র্য যেখানে নিয়মিত সঙ্গী, তার ওপর যুদ্ধের একটা বছর কোনো ফসল হয়নি। গোলায় খাদ্য নেই, কোনো কারেন্সি নেই। রাস্তাঘাট সব ভাঙা। সেই অবস্থায় যখন তিনি দেশ পরিচালনা করছেন, একটা জিনিস চিন্তা করেন, তিনি দেশে ফিরলেন ৭২ সালে। সেই ৭২ সাল থেকেই তো বিভাজন শুরু।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি হলো, জাসদ হলো। যারা পাকিস্তান বাহিনীর দোসর, যারা বড় নেতা ছিলেন, তারা তো পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে অনেক আগেই চলে গেছেন। আর যারা এ দেশে ছিল তারা কোথায় গেল? হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। তারা সব গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সাথে মিশে গেল।
‘আর আমাদের দেশের, আপনারা যদি পত্রপত্রিকা পড়েন, আপনারা এর পেছনে কে আছে না আছে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বেশি তো খোঁজার দরকার নাই। অনেক খবর আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বছরের পর বছর লেগে যায়। কিন্তু একটি বছরও সময় দেয়া হলো না। সাথে সাথে সমালোচনা শুরু হলো। আর ধৈর্য ধরা হলো না। এটা হলো না কেন, এটা নাই কেন নানা কথা লেখা হলো। কারা লিখেছিল? কাকে খুশি করতে এবং কারা এই হত্যাকাণ্ডের গ্রাউন্ড তৈরি করছিল?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি যারা সরাসরি হত্যা করেছে, তারা নিজেরা স্বীকার করেছে। বিবিসি ইন্টারভিউতে রশিদ-ফারুক বসে বলেছে তারা হত্যা করেছে। তার কারণ, একটা চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরানোর। অনেক অপপ্রচার চালিয়েও তাকে দূরে সরাতে পারেনি। আর সরাতে পারে নাই বলেই তারা এ হত্যাকাণ্ডটা ঘটিয়েছে, এটাই বাস্তবতা।
‘কাজেই তখন যারা সমালোচনা লিখেছে তারা তো এদেরই দোসর হিসেবে গ্রাউন্ড তৈরি করছিল। সেটা একটু আপনারা স্মরণ করে রাখবেন। তাহলে আর আপনাদের বেশি দূর যেতে হবে না খুঁজতে।’
জানি যেকোনো সময় চলে যেতে হবে
মৃত্যুর ভয়ে ভীত নন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তার বাবা এই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, তিনিও যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘জাতির পিতা রক্ত দিয়েছেন এ দেশের জন্য। রক্ত দিয়েছেন আমার মা-ভাইয়েরা। আমিও রক্ত দিতেই এই বাংলাদেশে এসেছি।
‘কাজেই আমি জানি, আমার জীবনের কোনো মায়া নেই। আমার কোনো চাওয়াও নেই। আমার একটাই চাওয়া, যে আদর্শ নিয়ে আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছে সে আদর্শ মানুষের কাছে পৌঁছে দেব।’
তিনি বলেন, ‘মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখেছি, কখনো ভীত হইনি। হবও না। আমি তো প্রস্তুত। আমি তো জানি, যেকোনো সময় আমাকে চলে যেতে হবে। যতটুকু সময় আছে দেশের জন্য কতটুকু করতে পারি যেন আমার আব্বার আত্মাটা শান্তি পায়।’
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহত পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একই দিন আমি হারিয়েছি আমার মাকে। সেই সাথে আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এবং ছোট্ট ১০ বছরের ভাইটি।
‘তারও (রাসেল) জীবনের স্বপ্ন ছিল যে একজন সেনা অফিসার হবে। তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। তাকেও ঘাতকের দল হত্যা করেছে। কামাল-জামালের নব পরিণীতা স্ত্রী, তাদের মেহেদির রংও তখন মুছেনি। বুকের রক্ত দিয়ে সেই রং ঢেকে গিয়েছিল।’
বাবা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা মানুষ তার জীবনের সবটা উজাড় করে দিয়েছিল একটি জাতির জন্য। নিজের জীবনের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি শুধু দেশের কথা ভাবতেন, মানুষের কথা ভাবতেন। শোষিত, বঞ্চিত মানুষগুলির তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
‘এই বঙ্গভূমিতে কোনোদিনই এ মাটির কোনো সন্তান কিন্তু এখানে সরকার গঠন করেনি বা রাজত্ব করেনি। সব সময় বাইরের মানুষ এসে শাসন করেছে। সেই মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমলেও আমরা দেখেছি। পাকিস্তান হওয়ার পরেও একই অবস্থা আমরা দেখেছি। একমাত্র বাংলাদেশের মাটির সন্তান বঙ্গবন্ধু।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘একটি জাতিকে তিনি দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় এনে দিয়েছিলেন। এ বিজয় যে আসবে তিনি জানতেন। তিনি সেই কথা সব সময় বলেছেন। আর দেশকে নিয়ে তার যে স্বপ্ন ছিল, সেটা তো আমি বড় সন্তান হিসেবে তার কাছে সে গল্প শুনতাম। আমরা তো খুব কম সময় পেয়েছি।
‘বেশির ভাগ সময় তো আব্বা জেলে থাকতেন। তার পাশে ছিলেন আমরা মা, শেখ ফজিলাতুন নেছা। সংগ্রামে যেমন সব সময় পাশে, সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার নিজের। কোনোদিন সংসারের কোনো কিছু নিয়ে বাবাকে উত্ত্যক্ত করা বা কোনো কিছু চাওয়া, দাবি করা কিছু ছিল না। মা একটা কথাই বলতেন, দেশের জন্য তুমি কাজ করে যাও, সংসার নিয়ে ভাবতে হবে না।’
মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেই প্রতিশোধ
দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনকেই নিজের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন বলে জানান সরকারপ্রধান। বলেন, ‘আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য মুক্তি দেয়া, তাদের জীবনটা উন্নত করা, তাদের জীবনটা সুন্দরভাবে গড়ে তোলা, যেটা আমার বাবার আজীবন লালিত স্বপ্ন।
‘সেটা যেদিন করতে পারব, আমি মনে করব এই হত্যার প্রকৃত প্রতিশোধ সেদিনই নিতে পারব। আজ আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।’