বঙ্গবন্ধুর জেল-জুলুম অত্যাচার, নির্যাতনে সাহস, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার কঠিন সময়ে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। নীরবে-নিভৃতে শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পেছনে তিনি রেখেছেন আলোকবর্তিকার ভূমিকা।
রোববার বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিশেষ আয়োজন ‘সতত প্রেরণাদায়ী বঙ্গমাতা’ ভার্চুয়াল আলোচনায় বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।
বঙ্গমাতার জন্মদিনে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য শেখ কবীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, রেণু (বঙ্গমাতা) আর খোকার (বঙ্গবন্ধু) বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য। কারণ বঙ্গবন্ধু আর শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের যদি বিয়েটা না হতো, তা হলে এই যে অনুপ্রেরণা, এই যে সাপোর্ট বঙ্গবন্ধু তখন কোথা থেকে পেতেন।
‘দেশ স্বাধীন হতো কি না সন্দেহ। আল্লাহই মনে হয়, রেণু আর খোকার মিল করে দিয়েছিল, সেই মিলটা করে দিয়েছিল বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য।’
তিনি বঙ্গমাতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বঙ্গমাতাকে আমি দেখেছি, আগরতলা মামলার সময় ওই কেস কিন্তু উনি হ্যান্ডেল করছেন। আমার মনে আছে, উনি এক উকিলের বাসায় গিয়েছিলেন। তখন, আমার বাবা সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। যখন উকিলের রুম থেকে আমার বাবা বের হলেন তখন দেখলাম উনি চোখ মুছতেছেন। কারণ উকিল তখন অনেক টাকা চেয়েছিলেন। এই টাকা জোগাড় করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ আমার বাবাদের এতো টাকা ছিল না।’
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, ‘একাত্তর সালে ক্র্যাকডাউনের পর যখন আর্মি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেল বঙ্গমাতা তখন আর্মিদের কন্ট্রোলে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডে।
তখন বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পিজি হাসপাতালে। সেই হাসপাতালে আমি যেতাম। সে সময় চাকরি দিয়ে আমাকে একটা কার্ড বানিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগেরই একজন। সে চাকরির সুবাদে আমি সেক্রেটারিয়েটে যেতাম, হাসপাতালেও যেতাম, খবর নিয়ে আসতাম। আমি বঙ্গমাতাকে খবরগুলো দিতাম।
‘আসগর খানের একটা খবর আমাকে দিয়ে পাঠানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। উনার (বঙ্গমাতা) যে কতো দূরদর্শিতা, উনি কিন্তু বুঝতে পারলেন আমাকে আর্মিরা ফলো করতেছে।
‘এর পরে আমি যখন একদিন গেলাম উনি বললেন, ভাই এরপর এদিকে আর তুই আসবি না। পারলে বাড়ি যা, ওখান থেকে ওপার বাংলায় চলে যা। উনি আমাকে বললেন, আমি যখন লিফটে উঠব তুই আর উঠবি না। তুই এখান থেকে কোথায় যাবি কেউ যাতে জানতে না পারে। তুই যেখানে থাকিস সেখানে যাবি না।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে ছিলেন তখন খবর উনার কাছে পৌঁছে দেয়া কিংবা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে খবর নেতাদের কাছে পৌঁছানো-এই সব কিছু কিন্তু উনি নিজেই করেছেন। অতএব তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উনার সহাযোগিতা ছিল অনেক। উনি হয়তো পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দেননি। কিন্তু উনি যা করছেন সেটা আর কেউ করতেও পারতো না।’
পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বঙ্গমাতার অভাববোধের কথা উল্লেখ করে শেখ কবীর হোসেন বলেন, ‘আমি তো খুবই অভাববোধ করি। আমরা মনে করি আমরা গার্ডিয়ানলেস হয়ে গিয়েছি। উনার মৃত্যুর পরে এবং ওই ঘটনা ঘটনার পরে পুরো পরিবারটা কিন্তু আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছি।’
এ সময় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারও দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘ওই পরিবারের একজন সদস্য ও একজন সিনিয়র নাগরিক হিসেবে আমি চাই ওই হত্যার পেছনে যারা ছিল, তাদের খুঁজে বের করে জাতির সামনে তুলে ধরা হোক। এর পর বিচার করে রায় দেয়া হোক এবং তা কার্য়কর করা হোক। তাহলে জাতি জানবে যে কারা এর নেপথ্যে ছিল।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গমাতা রাষ্ট্রপ্রধানের সহধর্মিনী হয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন। উনি নিজে রান্না করতেন, যা বঙ্গবন্ধু ভালবাসতেন। তার প্রমাণ আমি নিজেই। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলেই দেখতাম, বুজি (বঙ্গমাতা) রান্না করছেন।’
নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, বাঙালির সবচেয়ে সংগ্রামী ও মহানতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ পূরণে আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। আর বঙ্গবন্ধুর সব সংকটে, সংগ্রামে সাহস নিয়ে পাশে থেকেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় নির্ভরতা, আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা হিসেবে আজীবন অবিচল ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর জেল-জুলুম অত্যাচার, নির্যাতনে সাহস, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার কঠিন সময়ে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। নীরবে-নিভৃতে তিনি যে কতো কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে যিনি পাশে থেকে আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেছেন তিনি আমাদের বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর জীবনে সফলতার পেছনের গল্পের কারিগর বঙ্গমাতা, হার না মানা সংগ্রামী বাঙালি নারী। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন বাঙালির অস্তিত্বে থাকবেন, সতত প্রেরণাদায়ী নারী বঙ্গমাতা।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়লে দেখা যায় উনার সংসার ও রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনায় বার বার উল্লেখ করেছেন বঙ্গমাতার কথা। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও মামলা পরিচালনা, দলকে সংগঠিত করা, কর্মীদের সহায়তা, আন্দোলনের দিক নির্দেশনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা।
জেলখানায় বঙ্গবঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি সব পরিস্থিতি জানাতেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যে সব দিক নির্দেশনা নিয়ে আসতেন সেগুলো তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন বাস্তবায়নে বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর অসংখ্যা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বঙ্গমাতার বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এমন যে কোনো একটি সিদ্ধান্ত ভুল হলে বাংলাদেশের ইতিহাসও বদলে যেতে পারতো।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে ৬ দফা আন্দোলন তখনও শুরু হয়নি। এতো বড় আন্দোলনের ঝুঁকি নেয়ার ফলাফল কী হবে তা ভেবে চিন্তিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ আন্দোলন কেবল জেল-জুলুমে শেষ হবে না, হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা হতে পারে। এতো বড় ঝুঁকি নেয়ার আগে বেগম মুজিবের মতামত চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভয়ও ছিল যদি তিনি বেঁকে দাঁড়ান তাহলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আন্দোলনে নামা হয়তো কষ্টকর হবে।
বেগম মুজিব ছিলেন একজন অসম সাহসী দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুকে সাহস দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই বলে যে, ‘আপনি এতো ঘাবড়ান কেনো? আপনার আছে, হাজার হাজার তরুণকর্মী, ছাত্র-যুবক। তারা আপনার ডাক শুনলে হাসিমুখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি শেখ মুজিবের স্ত্রী, এই পরিচয় নিয়ে মরলেও খুশি হবো। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড় সাহেবের বিবি এই পরিচয় দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমি বছরের পর বছর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কষ্ট করিনি।’
‘বঙ্গবন্ধুর জীবনে রাজনীতিতে, আন্দোলনে-সংগ্রামে এমনকি সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেগম মুজিব ছিলেন বটবৃক্ষের ন্যায় এক কান্ডারি।’