চিত্রনায়িকা পরীমনির বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বনানী থানায় মাদক মামলা রেকর্ড হওয়ার পরই আদালত প্রাঙ্গণে শুরু হয় ব্যস্ততা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পুলিশ ও সংবাদকর্মী।
রঙিন পর্দার মানুষ পরীমনি, তাকে ঘিরে উৎসুক জনতার ঢল নামতে পারে সেই চিন্তা থেকে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল পুলিশ।
আদালতের আশপাশে ভিড়তে দেয়া হয়নি জনসাধারণকে, এমনকি আশপাশের সড়কেও কাউকে থামতে দেয়া হয়নি। নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয় পুরো আদালত চত্বর।
ফটকের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি আইনজীবী ও সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই। ভিতরেও ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
সন্ধ্যা ৮টা ১৫ মিনিটে পরীমনিকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আদালত চত্বরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সহযোগী দিপুসহ তাকে ৩৪ নম্বর আদালতে তোলা হয়।
প্রায় একই সময় কৌশলগত কারণে অন্য প্রবেশপথ ব্যবহার করে একই আদালতে হাজির করা হয় প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ ও তার সহযোগী সবুজকে।
শুনানি শেষে প্রায় ৫০ মিনিট পর তাদের আদালত থেকে নিচে নামানো হয়। আবারও কৌশল বদলে অ্যাম্বুলেন্সের পরিবর্তে একটি কালো মাইক্রোবাসে পরী ও তার সহযোগী এবং অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে রাজ ও তার সহযোগীকে নিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে চলে যায় বনানী থানা পুলিশ।
পরীমনিকে আদালতে আনার খবরে আদালতের ফটকের বাইরে ও রায় সাহেব বাজার সড়কে ভিড় ছিল জনতার। কেউ কাছে যেতে না পারলেও বৃষ্টিতে ভিজে দূর থেকে দাঁড়িয়েই এক ঝলক দেখেছেন এই তারকাকে।
৪৭ মিনিটের শুনানি
চিত্রনায়িকা পরীমণি ও রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজসহ চারজনকে আলাদা দুই মামলায় চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন বিচারক।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ২২ মিনিটে ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালতে দুই মাদক মামলায় শুনানির জন্য পরীমনি ও রাজসহ চার আসামিকে হাজির করা হয়।
অপর দুই আসামি হলেন পরীর সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দিপু ও রাজের সহযোগী সবুজ আলী। মাদকের দুই মামলায় তাদের চারজনেরই সাত দিন করে রিমান্ড চায় বনানী থানা পুলিশ।
কাঠগড়ায় উঠেই পূর্বপরিচিত এক আইনজীবীকে জড়িয়ে ধরেন পরীমনি। বিচারক মামুনুর রশীদ রাত ৮টা ২৮ মিনিটে এজলাসে বসেন।
সব ঠিক থাকলেও পরীর ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিয়ে পরীর পক্ষে লড়তে আইনজীবীদের দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। আইনজীবী নিলাঞ্জনা রেফাত সুরভী ও গোলাম কিবরিয়া যোবায়েরের মধ্য চলে তর্ক। বিশৃঙ্খলা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ৮টা ৩৫ মিনিটে এজলাস ছাড়েন বিচারক। পরে অন্য আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে শান্ত হয় পরিবেশ।
আইনজীবী নিলাঞ্জনা রেফাত সুরভীর ওকালতনামায় সই করেন পরীমনি। আর তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দিপু স্বাক্ষর করেন গোলাম কিবরিয়া যোবায়েরের দেয়া ওকালতনামায়।
এ ছাড়া নজরুল ইসলাম রাজ ও তার সহযোগী সবুজ আলীর পক্ষে মামলা লড়ার জন্য ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান রচি ও সাবেক সহকারী সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান হিমেলকে ওকালতনামায় ক্ষমতা দেয়া হয়।
এ সময় আদালতে উপস্থিত অনেক পুলিশ সদস্য মাস্ক খুলে পরীমনির দাঁড়ানো কাঠগড়ার কাছে সেলফি তোলেন। এ ছাড়া কয়েকজন আইনজীবীকে দেখা যায়, আদালতের মধ্যে সেলফি তুলতে। এক পর্যায়ে জেষ্ঠ্য কর্মকর্তার ধমকে তা বন্ধ হয়।
রাত ৮টা ৩৬ মিনিটে মহানগর হাকিম মো. মামুনুর রশিদ ফের এজলাসে উঠে শুনানি শুরু করেন।
আদালত চলার সময় পরীমনি ও রাজসহ আসামিরা ছিলেন অনেকটা নিষ্প্রভ। বিশেষ করে পরীমনিকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এক অজানা অচেনা রাজ্যে প্রবেশ করে পথ হারিয়েছেন।
রিমান্ড আদেশ শুনানির আগে বিচারক তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার কিছু বলার আছে কি না?
পরীমনি তখন বিচারককে জানান, তিনি নির্দোষ। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
সাত দিনের আবেদনে চার দিনের রিমান্ডের আদেশ শুনে পরীমনির মুখে মাস্কের আড়ালে বিষাদের কালো ছায়া ফুটে ওঠে। ছলছল চোখে এজলাস থেকে তাকে পুলিশের নারী সদস্যরা নামিয়ে নেন।
রাত ৯টা ১৫ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়।
এরপর প্রথমে পরীমনি ও দিপুর মাদক মামলায় রিমান্ড শুনানি হয়।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘পরীমনির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এই মাদকের পরিণতি সর্বনাশা। উঠতি বয়সীরা মাদকে আসক্ত হচ্ছে। আসামিদের মত মুখোশধারীদের অপকর্মে সমাজ কলুষিত হচ্ছে। তাদের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।’
পরীমনির পক্ষে তার আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত সুরভী বলেন, ‘পরীমনি একজন স্বনামধন্য চিত্রনায়িকা। সবাই তাকে চেনে। তাকে যে সিস্টেমে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা দুঃখজনক। সাজানো ঘটনায় তাকে গেপ্তার করা হয়েছে। ক্যারিয়ার নষ্ট করতে এ মামলা। প্রতিহিংসার বশে মামলাটি করা হয়েছে। তার অপরাধ খুবই সামান্য। চক্রান্তের শিকার তিনি। তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন প্রার্থনা করছি।’
এরপর আদালত পরীমনি ও তার সহযোগীর চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
পর পরই রাজ ও সবুজ আলীর রিমান্ড শুনানি হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পরীমনির বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে রাজের নাম জানায় পরীমনি। পরে রাজের বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ তাকে ও তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।’
রাজের পক্ষে আইনজীবীরা বলেন, ‘রাজ এফবিসিসিআই সদস্য, একজন সিআইপি। তার যাতায়াত সরকারের নজরে পড়বে। তার মাদক সেবনের লাইসেন্স আছে। মদ তিনি রাখতেই পারেন। কোনো ইয়াবা তার বাসা থেকে পাওয়া যায়নি। যে সব মাদক উদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে তাও পাওয়া যায়নি। রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করছি।’
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রাজ ও সবুজের চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।