ছোট ভাই শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষকিীতে তাকে স্মরণ করতে গিয়ে বার বার চোখ ভেজালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তুলে ধরলেন নানা স্মৃতি।
বৃহস্পতিবার শেখ কামালের জন্মদিনের সকালে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ কামালের জন্মদিন। কামাল আমার ছোট। আমরা দুই ভাই-বোন পিঠাপিঠি। এক সাথেই খেলাধুলা করতাম।’
শেখ কামালকে বঙ্গবন্ধু বেশি আদর করতেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কামালের জন্মের পরই বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫২ সালে তিনি মুক্তি পান। বাবার স্নেহ থেকে সে বঞ্চিত ছিল। আমিও ছিলাম। কিন্তু বাবার স্নেহটা সে একদমই পায়নি। বাবা ওকে বেশি আদর করতেন যেহেতু ছোটবেলায় সে বঞ্চিত হয়েছিল।’
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলে তার অনেক দায়িত্ব মা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে মিলে শেখ কামালই পালন করতেন বলে জানান শেখ হাসিনা। বললেন, বয়সে ছোট হলেও চিন্তাচেতনায় সব দিক থেকে শেখ কামালের মধ্যে কর্তব্যবোধ ছিল। পিঠাপিঠি হওয়ায় নিজেদের মধ্য ভালো সমঝোতাও ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কামালের বিভিন্ন গুণের মধ্যে সংগঠন করা, খেলাধুলা…এমন কোনো খেলা ছিল না যেখানে তার পারদর্শিতা ছিল না। সংস্কৃতিচর্চাতেও সে যথেষ্ট পারদর্শী ছিল। ছায়ানট যখন হলো আমরা সবাই তার সদস্য হলাম। কামাল সেতার, আমি ভায়োলিন, জামাল গিটার আর রেহানা গান শিখত। আমরা ছেড়ে দিলেও সে ধরে রাখে।
‘তখন ধানমন্ডিতে খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানকার তরুণ ও শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করতেই আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠা করে কামাল। কামালের খুব সুন্দর গলা ছিল। কামাল ঘরে ঢুকলে... হাঁটতে চলতে গান গাইত। সেটা শুনলেই বোঝা যেত কামাল আসছে।’
শুধু খেলাধুলা বা সংস্কৃতিচর্চায় নয়, শেখ কামাল একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন বলে জানান বড় বোন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের সদস্য ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরও তা চালিয়ে যায়। অদ্ভুত সাংগঠনিক দক্ষতা তার ছিল।
‘ছয় দফা দেয়ার পর সে সময় যে আন্দোলন সংগ্রাম তাতে সক্রিয় ভূমিকা ছিল কামালের। আমরা সকলেই ছিলাম, কিন্তু কামাল ছিল সবচেয়ে সক্রিয়।’
ভাইয়ের কথা মনে করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। নিজেকে সামলে আবার বলে চলেন, ‘টেপ রেকর্ডার দিয়ে গান সংগ্রহ করত। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে সেগুলো প্রচার করত। নাটকে পারদর্শিতা ছিল, যেকোনো চরিত্রে সে অভিনয় করতে পারত। যেকোনো কাজে হাত দিলে সেখানে কামাল সাফল্য অর্জন করত। বেঁচে থাকলে আরও অনেক কাজ সে করে যেতে পারত।
‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল কামাল। ৭০-এর নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের দাপট ঢাকায়। আমরা প্রতিদিন প্রচারে যেতাম। নিবার্চনে মানুষকে সম্পৃক্ত করা... সিল মেরে কীভাবে ভোট দিতে হবে এটা মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এলাকা ভাগ করা থাকত, আমরা যেতাম। কামাল যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে কাজগুলো করত।’
এ সময় শেখ কামালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘটনাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের মঞ্চেও কামাল ছিল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই ধানমন্ডির যত যুবক তাদের সংগঠিত করে ব্যারিকেড দেয়ার একটি নির্দেশনা পালনে সে মাঠে নেমে যায়।
‘২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী আমাদের বাসায় হামলা চালায়, আব্বাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। তার আগে থেকেই সে বাড়ির বাইরে। আব্বাকে গ্রেপ্তার করেছে শুনে ২৫টা বাড়ির ৫০টা ওয়াল টপকে সে মাকে দেখতে আসে। পরের দিন বাড়িতে আক্রমণ করে। এ সময় অন্য একটি বাড়িতে থেকে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পরে ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেয়। এ সময় কয়েকজনকে অফিসার হিসেবে ওয়ার ট্রেনিং দেয়া হয়, তার মধ্যে কামাল একজন। পরে তাকে জেনারেল ওসমানীর এডিসি নিয়োগ দেয়া হয়।
‘২৫ মার্চের পর মাকেও গ্রেপ্তার করা হলে সে সময় জামালও অ্যারেস্ট হয়। আমাদের ধানমন্ডিরই একটি বাসায় রাখা হয়। আমি, রেহানা, রাসেল, জামাল সেখান ছিলাম। জামাল সেখান থেকে গেরিলা কায়দায় বেরিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও আমরা মুক্ত হই ১৭ ডিসেম্বর। ১৭ ডিসেম্বর কামাল-জামাল ফিরে আসে। এরপর থেকে মার সাথেই ছিল।’
অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ কামাল-ফাইল ছবি১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ খ্যাতিপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে শেখ কামালের বিয়ে হয়েছিল। এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি।
ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বোন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘সুলতানা-কামালের সংসার আর করা হলো না। তাদের জীবনটা অধরাই থেকে গেল। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’
শেখ কামাল খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করত জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার ছোট ভাই, নিজেই বলতে পারি, সাদাসিধে জীবন যাপন করত! কখনও বিলাশে তার দৃষ্টি ছিল না। অর্থ সম্পদের বিষয়েও তার কোনো নজর ছিল না।
‘আমরা ১৯৭৫-এর ৩১ জুলাই জার্মানি যাই। আর ১৪ জুলাই কামালের বিয়ে হয়, ১৭ জুলাই জামালের। আমি যখন জার্মানি যাচ্ছি কামালকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর জন্য কী নিয়ে আসব? সে আমাকে বলল, খেলোয়াড়দের জন্য বুট নিয়ে এসো। আমি বললাম, কী বুট? পড়ে ডায়রিতে নাম লিখে দিল, এডিডাস বুট। তার বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। আমি বললাম কী আনব, সে বলে খেলোয়াড়দের বুট। নিজের জন্য কিছুই চাইল না। খেলোয়াড়দের বুটই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’