করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শাটডাউন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চলমান কঠোরতম বিধিনিষেধ শেষ হচ্ছে ৫ আগস্ট। এরপর কী হবে, তা নিয়ে দোটানায় সরকার। এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন না সরকারের কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।
তবে অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়ে সামনে আর লকডাউন, শাটডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ না দেয়ার পক্ষে সরকারের একটি অংশ। তারা বলছেন, করোনা প্রতিরোধী টিকার সংস্থান হওয়ায় স্বস্তি ফিরে পেয়েছে সরকার। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে চলার শর্তে ৫ আগস্টের পর শাটডাউন তুলে দেয়া উচিত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা চলমান শাটডাউন দীর্ঘায়িত করার পক্ষে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে শাটডাউন দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা খুব মুশকিল। দেখলেন তো মাঠে আর্মি নামিয়েও কাজ হচ্ছে না। মানুষ বাইরে আসছেই। কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না।’
আরেক কর্মকর্তা বললেন, ‘আমাদের মতো অর্থনীতির দেশে দিনের পর দিন এভাবে সব বন্ধ রেখে চলা সম্ভব নয়। অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার মতো চ্যালেঞ্জ নেয়ার ক্ষমতা এখনও আমাদের নেই। এটা বাস্তবতা। মানুষকে কাজের সুযোগ দিতে হবে, আয়ের সুযোগ দিতে হবে। নতুবা পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে।’
নিম্নবিত্ত কিছু ত্রাণ পেয়ে কোনো রকম চললেও মধ্যবিত্তের অবস্থা নিয়ে সরকার বিচলিত বলেও জানান এই দুই কর্মকর্তা।
অর্থনীতি যে সরকারের মাথাব্যথার বড় কারণ, তার প্রমাণ মিলেছে চলমান শাটডাউনের মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে। ফলে ঢাকামুখী হয়েছেন শ্রমিকরা। তাদের ভোগান্তি কমাতে খুলে দেয়া হয়েছে গণপরিবহন ও নৌযান। তবে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, এতে করোনা সংক্রমণ আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শাটডাউন বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোববার বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই কঠোর বিধিনিষেধ চলমান থাকবে। ঊর্ধ্বমুখী করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ অবশ্যই থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার মধ্যে সরকারের জীবন-জীবিকার ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। সরকারের সব দিকে নজর রয়েছে। ব্যালেন্স সব সময় ঠিক রাখা যায় না। বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন খুলে দেয়া হয়েছিল। আবার তারা লকডাউন দিয়েছে।’
প্রতিদিন দুই শর বেশি লোক মৃত্যুবরণ করছে, ১০ হাজারের বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘এই সংক্রমণ আমরা কমিয়ে আনতে চাই। তবে যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তাহলে এটি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।’
করোনার এই পরিস্থিতির মধ্যেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের যুক্তি, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমানুষকে সচেতন হতে হয়। সে ক্ষেত্রে শাটডাউন না দিয়েও সেটা সম্ভব।
বিভিন্ন উৎস থেকে টিকার জোগান নিশ্চিত হওয়ায় সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের একটু সুবিধা হয়েছে বলে মনে করেন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সিরাম চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। তবে এখন নানা উৎস থেকে টিকার সংস্থান করতে সরকার সফল হয়েছে। আর টিকা প্রয়োগ হলে করোনার ভয়াবহতা অনেকাংশে কমে আসবে।’
গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, করোনা প্রতিরোধী ২১ কোটি টিকার সংস্থান হয়েছে। আর এই ২১ কোটি ডোজ দিয়ে দেশের ১৪ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে রোববার সচিবালয়ে শাটডাউন অব্যাহত রাখা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে এড়িয়ে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেখেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত যেখান থেকে নেয়, সেটা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়। লকডাউন যেখান থেকে শিথিল করে বা চালু করে, তারাই এটার উত্তর দিতে পারবে।’
শাটডাউন না মানাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও কিছু খোলাসা করেননি। তিনি শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এর মধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নেব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৫ তারিখের পর কী হবে। ৩/৪ তারিখে আমরা জানিয়ে দেব, আমরা কী করতে যাচ্ছি। কী পরিসরে খুলবে অথবা কী হবে, সে বিষয়ে আমরা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানাবেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
সরকার সম্ভাব্য সব বিকল্প মাথায় রেখে করণীয় নির্ধারণ করতে চায় বলেও জানান তিনি।
ফরহাদ বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে যতগুলো বিকল্প আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবা হচ্ছে…হয়তো অফিস খোলা রাখলে সেখানে আমাদের লোকবল কত থাকবে, সেটির একটি ব্যাপার আছে। মানুষ যাতে ঘর থেকে কম বের হয়, সে জন্য কী করা যায়, যতগুলো বিকল্প আছে, আমরা সেই বিকল্পগুলো নিয়ে ভাবছি।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কোরবানির ঈদের পর ২৩ জুলাই সকাল থেকে শাটডাউন দেয় সরকার। বর্তমান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এটি চলবে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত।