গত সপ্তাহে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এখনও তার এই সফরের রেশ রয়ে গেছে কূটনৈতিক পাড়ায়।
তাসখন্দ ফেরত পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে সবাই উচ্ছ্বসিত।
তিনি বলেন, ‘এই সফরে আমার তুরস্ক, চীন, ভারত, কুয়েত, রাশিয়া, তাজিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। সবাই বাংলাদেশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত। এটি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য। বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য। এই সফরে আমি টের পেয়েছি, বাংলাদেশকে এখন সবাই ভালোই পাত্তা দেয়। হিসাবে ধরে।’
মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ তাসখন্দ সফর সম্পন্ন করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে তিনি উজবেক প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও দেশটির পাঁচ মন্ত্রীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন।
এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং য়ি, তাজিকস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহরিদ্দীন, কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আহমেদ নাসের আল মোহাম্মেদ আল সাবাহার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, একইসঙ্গে চীন, ভারত ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতার উদাহরণ। বৈশ্বিক কূটনীতির ভারসাম্য, করোনাভাইরাস টিকার রাজনীতি, রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও দেশ তিনটি বাংলাদেশে কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের কাজ করছে। তাই বাংলাদেশের চেক এন্ড ব্যাল্যান্সড কূটনীতির ক্ষেত্রে বৈঠকগুলোর গুরুত্ব ছিল।
সঠিক সময়ে টিকা প্রাপ্তি, খুলনা মোংলা রেললাইনসহ ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, টিকার যৌথ উৎপাদন, পদ্মাসেতু ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্প সময় মতো বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার তৎপরতা বেশি প্রয়োজন ঢাকার।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন।
তাসখন্দ সফরে মোমেনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা হয়েছে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুৎ সাবুসোলুর। এ সম্পর্কে উচ্ছ্বাস জানালেও বৈঠকের বিষয়বস্তু জানাননি তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে বড়ই উচ্ছ্বসিত। আমরা একইসঙ্গে ছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য পর্যায়ের সম্পর্ক চায় দেশটি।
বৈঠকের কয়েকদিন পরই তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আল সাবাহ এক প্রতিবেদনে জানায়, তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ইস্তাম্বুল ক্লাসের ফ্রিগেট চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে কুয়েত বাংলাদেশের অন্যতম শ্রম বাজার। দেশটির ওই বাজার হুমকিতে পড়েছে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের মানবপাচার মামলায় আটকের কারণে। পাপুল বর্তমানে জেলে থাকলেও এই ঘটনা ব্যাপক নাড়া দিয়েছে দেশটির প্রশাসনিক কাঠামোতে। পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে কুয়েতের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারে এ বৈঠক কাজে লাগবে বলে মনে করে মন্ত্রণালয়।
এছাড়া মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়াতে বাংলাদেশের আইডিয়া কাজে লাগাতে চায়। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে দেশটিতে তথ্য ও প্রযুক্তিখাতে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেখছে বাংলাদেশ।
একইসঙ্গে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যেরও রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। বিশ্বের উন্নত মানের তুলা ও প্রধান সুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ উজবেকিস্তান। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর তুলা আমদানিকারক দেশ। আবার তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। কিন্তু দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নেই বললেই চলে। এছাড়া কৃষি, ফার্মাসিটিক্যালসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে দুই দেশের কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে তাসখন্দ সাক্ষাৎ উপলক্ষে এক লাখ ডোজ কোভিড টিকা উপহার দিয়েছেন। দ্রুত সময়ে বাংলাদেশে টিকার যৌথ উৎপাদন শুরুর অঙ্গীকার করেছেন। একইসঙ্গে কোভিডের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য কমাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি দ্রত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে তিনপক্ষের শারীরিক বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। একইসঙ্গে আমাকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দ্রুত সময়ে আমি ওই সফরে যাব।’
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, উজবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশটি শিগগিরই বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালু ও ঢাকায় কনসাল অফিস চালুর প্রতিশ্রতি দিয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতে যৌথ বিনিয়োগ ও অন্যান্য খাতের উন্নয়নে রোডম্যাপ চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভ।
১৮ জুলাই উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাহভকত মিরজাইয়েভের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশে আসতে পারেন জানিয়ে মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচরাচর কোনো দেশে যান না, বিশেষত স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাকে বৈঠকে দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে দুই দেশ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হলেই সেটি সই করতে ঢাকা আসবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।’
মোমেন বলেন, ‘আমি তাকে বললাম রোহিঙ্গা ফেরাতে আমি চাই আপনি এই ট্রাইলেটারাল উদ্যোগে অংশ নিন এবং রোহিঙ্গা ফেরাতে ভূমিকা রাখেন। আপনার সঙ্গে তাদের এতো ভালো সম্পর্ক, এই সেদিন ওদের (মিয়ানমার) মিলিটারি চিফ আসলো। আপনারা তাদের জিনিসপত্র দিচ্ছেন। আপনারা বললে ওরা শুনবে।’
তাসখন্দে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন
তিনি বলেন, ‘তাসখন্দে কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আহমেদ নাসের আল মোহাম্মেদ আল সাবাহার সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। আমি তাকে আমাদের দেশের মানুষের সমস্যার কথা বললাম। তিনি এজন্য মন্ত্রী পর্যায়ে একটি জয়েন্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। যেমন ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের আছে। একইসঙ্গে কুয়েত একটি রোডম্যাপ তৈরির কথাও বলেছে, যা দুই দেশের কাজের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করবে।’
তাসখন্দে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন ও কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আহমেদ নাসের আল মোহাম্মেদ আল সাবাহা
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি বললাম আমাদের দেশের অনেক মানুষ তোমাদের দেশে কাজ করত। তারা এখন সমস্যায় আছে। তাদের দোকান, ব্যবসা আছে। তোমরা এখন তোমাদের দেশে আমাদের দেশের লোকদের যাইতে দিচ্ছ না।
‘‘জবাবে কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেন, ‘পাপুলের কারণে তোমাদের অনেক বদনাম হয়ে গেছে। বিরাট বদনাম হয়ে গেছে। তারপরও আমরা ভিসার সহজ পথ তৈরি করছি।’’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠক সম্পর্কে বলেন, ‘জয়শঙ্কর আবারও বাংলাদেশে টিকা সরবরাহের বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন ও অসম্পন্ন সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’