গত এপ্রিলে লকডাউন চলাকালে কয়েকজন চিকিৎসককে রাস্তায় পুলিশের হয়রানি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের পর এবার শাটডাউনে আর এই ধরনের কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে ঈদের পর থেকে শুরু হওয়া শাটডাউনের দ্বিতীয় পর্বে একাধিক ব্যাংকারকে পরিচয়পত্র থাকার পরেও তাদের জরিমানা করা হয়েছে। একজনের গায়ে হাত দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গত এপ্রিল লকডাউন এবং জুলাই থেকে শুরু হওয়া শাটডাউনে জরুরি সেবা চালু আছে। এর মধ্যে আছে ব্যাংকও। সীমিত পরিসরে হলেও প্রতিষ্ঠান চালু আছে। আর ব্যাংকারদের শাটডাউনে চলাচলে বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
তার পরেও পুলিশের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়েছে। ব্যাংকারদের নানা ফেসবুক গ্রুপে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে।
আবার শাটডাউনে ব্যাংকগুলোকে তাদের কর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অনেক ব্যাংক এই ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দীর্ঘপথ রিকশায় পাড়ি দিয়ে বা হেঁটে অফিসে যেতে হচ্ছে কর্মীদের।
আর এই পথে রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। পরিচয় দেয়ার পরেও পুলিশ হেনস্থা করছে বলে জানাচ্ছেন ব্যাংককর্মীরা।
বাইকে থাকা ব্যাংককর্মীকে মারধরের অভিযোগ
ডাচবাংলা ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের গোপালদী শাখার কর্মী আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা ফতুল্লা থেকে মোটরসাইকেলে করে রওনা হওয়ার পর সাইনবোর্ড এলাকায় পাম্পে তেল নেয়ার সময় এক সার্জেন্ট তাকে ৬ হাজার টাকার মামলা দেয়ার হুমকি দেন।
বাদানুবাদের একপর্যায়ে অন্য পুলিশ সদস্যরাও এসে মুসাকে হেনস্থা করেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। বলেছেন, তাকে মারধরও করা হয়েছে।
পরে পুলিশের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা এসে এই ব্যাংকারকে উদ্ধার করেন আর পুলিশ সেই সার্জেন্টকে প্রত্যাহার করেছে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি ব্যাংকারদের ফেসবুক গ্রুপে এভাবে ছড়িয়েছে
নিউজবাংলাকে আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘পুলিশ যেমন জনগণের সেবা করছেন, তেমনি আমরাও গ্রাহককে সেবা দিচ্ছি। গ্রাহকদের সুবিধার্থে সীমিত পর্যায়ে ব্যাংক খোলা রাখা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি জেনেও কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু পদে পদে হয়রানির শিকার আমরা।‘
তবে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম দাবি করেছেন, ঘটনা উল্টো। সেই ব্যাংকার উল্টো পথে ছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘শাটডাউনের মধ্যে বের হয়েছেন, এ কারণে আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা দিইনি। পুরো ফাঁকা রাস্তায় তিনি উল্টো পথে যাচ্ছিলেন, এ জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে।’
তবে পরে সে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় বলেও জানান এসপি।
গত এপ্রিলে একজন চিকিৎসককে জরিমানার পর বিষয়টি ভাইরাল হলে তার মামলাও একইভাবে প্রত্যাহার করে জরিমানার টাকা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এই ঘটনায় পুলিশ সার্জেন্ট মো. শফিককে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সালেহ উদ্দিনের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো।
এই ব্যাংকার যে মারধরের অভিযোগ এনেছেন, সেই বিষয়টি অসত্য বলে দাবি করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তাকে প্রত্যাহার করা হয়নি। উনি যে স্পটে দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেখান থেকে সরিয়ে অন্য স্পটে দেয়া হয়েছে।’
তিনি যদি কোনো অন্যায় না করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা কেন, এমন প্রশ্নে এসপির কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
পরিচয়পত্র দেখানোর পরও জরিমানা
একই রকম ঘটনা ঘটেছে রবগুনায়। মাসুম বিল্লাহ নামে একজন ব্যাংকারের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। তিনি কাজ করেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ঈদের ছুটি শেষে তিনি বাইকে করে শনিবার রওনা হন কর্মস্থলে যোগ দিতে।
কিন্তু বরগুনায় তাকে আটকে ২০০ টাকা জরিমানা করে ট্রাফিক পুলিশ। মাসুম বিল্লাহ তাকে জরিমানার রসিদ ফেসবুকে পোস্ট করে লেখেন, ‘ব্যাংক খোলা রাখল আবার ব্যাংকারের কাছে জরিমানাও নিল। বুঝলাম না কী আইন দেশে চলতেছে।’
বরগুনায় জরিমানা করার পর রসিদ পোস্ট করেন ভুক্তভোগী ব্যাংকার মাসুম বিল্লাহ
তিনি জানান, তার গলায় পরিচয়পত্র ঝোলানো ছিল আর তিনি নিজের পরিচয়ও দিয়েছেন। তার পরেও শাটডাউনের মধ্যে বাইক চালানোয় তাকে জরিমানা করা হয়।
কর্মস্থলে যেতে পদে পদে ভোগান্তি
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। তারও কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু বাস করেন ঢাকায়।
লকডাউনে সকালে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমেই ধাক্কা খান। দেখেন, রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। এরপর রিকশায় গুলিস্তান, সেখান থেকে আবার রিকশায় পোস্তগোলা। এরপর আরও দুই দফা রিকশায় যাওয়ার পর অফিসে পৌঁছান এক ঘণ্টা দেরিতে, বেলা ১১টায়।
রিকশা পরিবর্তন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেক সব মিলিয়ে রাস্তায় চলে গেছে তিন ঘণ্টা। খরচ হয়েছে ৪৪০ টাকা।
আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে প্রতিদিন এভাবে অফিসে আসা-যাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। অফিস যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা করেনি। এভাবে প্রতিদিন যাতায়াত করলে বেতনের একটা বড় অংশ এখানেই খরচ হয়ে যাবে। আর বিড়ম্বনা তো আছেই।’
সকাল সাড়ে ৭টা। মিরপুরের ছাপড়া মসজিদ থেকে পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডে রূপালী ব্যাংকের শাখায় যাবেন বাদল মিয়া।
মেলেনি ব্যাংকের পরিবহন, তার নিজস্ব কোনো বাহনও নেই।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কোনো ব্যবস্থা না করতে পেরে কর্মস্থলের উদ্দেশে রিকশায় ওঠেন। তারপরও পদে পদে বাধা। প্রথমে আগারগাঁও, এরপর বিজয় সরণি, তারপর ফার্মগেটে বাধার সম্মুখীন হন। এরপর কিছুক্ষণ হেঁটে আবার রিকশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকায় তার কর্মস্থলে পৌঁছান।
লকডাউনে ব্যাংকারদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকই তা মানছে না। ব্যাংকের কর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা স্ব স্ব ব্যাংক করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ব্যাংকের চিত্র এমনই।
রূপালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাদল মিয়া বলেন, ‘কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা না থাকায় অফিসে পৌঁছাতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। প্রধান কার্যালয়ে কর্মরতদের যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও শাখা পর্যায়ে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই।’
অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকের শাখা খোলা সেটা সমস্যা না। তারা সেবা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু লকডাউনে জরুরি সেবাদানকারী ব্যাংকারদের সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা ও প্রণোদনা দেয়াসহ নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা জরুরি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাহক ও ব্যাংকারদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে বলব। কার্ড দেখার পর হেনস্তা করা ঠিক নয়। আর সরকার ঘোষিত করোনা সতর্কতায় যে ছুটি সেটাও আমরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বিবেচনা করেছি। তাদেরকে সীমিত পরিসরে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। আগের মতো পূর্ণ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়নি।’
করোনা মহামারি শুরুর পর গত মে পর্যন্ত ১৫ মাসে মারা গেছেন দেশের ব্যাংকের ১৩৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ হাজার ৩৯৯ জন।
জুন ও চলতি জুলাইয়ে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ২০৬ জন। আর গত মে পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ হাজার ৩৯৯ জন। ফলে ব্যাংকের জনবলের প্রায় ১৪ শতাংশই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনায় মারা যাওয়া ১৩৩ কর্মকর্তার মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোরই ৭৩ জন। করোনায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। ব্যাংকটি করোনায় ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হারিয়েছে।