তিন বছর বয়সী রাবেয়া আক্তার ও পাঁচ বছর বয়সী মো. বোরহান। একসঙ্গে খেলছিল শরীয়তপুরের সখীপুর উপজেলার দক্ষিণ তারাবুনিয়া গ্রামে। রাবেয়া পুকুরে পড়ে যায়, আর তাকে তুলতে নামা বোরহানও বেঁচে ফিরতে পারেনি।
দুটি শিশু সম্পর্কে চাচাতো ভাইবোন। তাদের এমন মৃত্যুতে পরিবার দুটিতে শোকের পাশাপাশি সহমর্মী এলাকাবাসীও।
নদীমাতৃক আর পুকুরে পুকুরে ছেয়ে থাকা বাংলাদেশে শিশুদের এ ধরনের মৃত্যৃর খবর মোটেও বিরল নয়। বরং সবচেয়ে বেশি শিশুমৃত্যু কোনো রোগের কারণে নয়, হয় পানিতে পড়ে যাওয়ার কারণে।
পানিতে ডুবে এই মৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে দেখে বাংলাদেশ। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে বাংলাদেশের উদ্যোগে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এই কেন্দ্রিক একটি দিবসও ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে জাতিসংঘে প্রস্তাব তুললেও খোদ বাংলাদেশেই বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে তেমন সচেতনতামূলক প্রচার নেই। আর এই দিবসে রোববার তিন জেলায় ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য এসেছে। তবে প্রকৃত মৃত্যু আরও অনেক বেশি। দিনে গড়ে ২৭ জনের বেশি মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে।
গত ১৯ মাসে ৯৬৭টি ঘটনায় এভাবে পানিতে ডুবে ১ হাজার ৩৩২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমষ্টির এক গবেষণায়। এদের সিংহভাগই শিশু।
এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ বা ১ হাজার ৩০৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় এই গবেষণাটি হয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে। ফলে গণমাধ্যমে আসেনি, এমন আরও অনেক ঘটনা রয়ে গেছে হিসাবের বাইরে।
সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পানিতে ডুবে কতজন বছরে মারা যায়, তার হিসাবটাই একসময় ছিল না। সড়ক দুর্ঘটনার মতোই যে এটারও ভয়াবহ রূপ আছে, তা অনেকের অজানা।’
তিনি বলেন, ‘পানিতে ডোবার প্রধান কারণ সাঁতার না জানা। তাই এটা নিয়ে প্রচারটা করা জরুরি। শিশুদের সাঁতার শেখানোর কাজটি একেবারে কম বয়স থেকে শুরু করতে হবে।’
সমষ্টির গবেষণা অনুযায়ী যারা পানিতে ডুবে মারা গেছে তাদের ৭০ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম।
আর এদের মধ্যে নারী ও কন্যাশিশু ৩৬ শতাংশ আর পুরুষ ও ছেলেশিশু প্রায় ৬৪ শতাংশ। কারণ, ৬ জনের লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি সংগঠনটি।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে
গত ১৯ মাসে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে এই বিভাগে। এই বিভাগের ১১ জেলায় অন্তত ২৭১ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক ২২৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে।
এই হিসাবে অবশ্য নৌযান দুর্ঘটনার হিসাবও যুক্ত আছে।
জেলায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কুড়িগ্রামে
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে বন্যাপ্রবণ এই জেলায় অন্তত ৬৩ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের ৪৫ জনের বয়স ৯ বছরের কম। পারিবারিক সদস্যদের অগোচরে শিশুরা পানির কাছে চলে যায়।
আরও ১৭টি জেলায় অন্তত ৩০ জন বা তার বেশিসংখ্যক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে নেত্রকোণায় ৫৪ জন, কিশোরগঞ্জে ৪৩, চট্টগ্রামে ৪২, পটুয়াখালীতে ৩৯ এবং দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জে ৩৭ জন করে পানিতে ডুবে মারা যায়।
অন্যদিকে শরীয়তপুরে পানিতে ডুবে সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু ঘটে। গত ১৯ মাসে এই জেলায় দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
কম মৃত্যুর দিক থেকে নড়াইল, মাগুরা, বান্দরবান, রাজবাড়ী ও খুলনাও রয়েছে। এসব জেলায় উল্লিখিত ১৯ মাসে মৃত্যু ছিল দুই থেকে পাঁচজনের মধ্যে।
সিংহভাগই শিশু
পানিতে ডুবে যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে চার বছর বা কম বয়সীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ৫৬২ জন বা ৪২ শতাংশ।
৫ থেকে ৯ বছর বয়সী আছে ৪৬২ জন বা ৩৫ শতাংশ।
১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আছে ১৫২ জন এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে আছে ৩৮ জন। ১১৮ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
পানিতে ডোবার ঘটনা বেশির ভাগই দিনের বেলায়
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পানিতে ডোবার ৭৯ শতাংশ ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়। দিনের বেলায় শিশুরা পানির সংস্পর্শে বেশি যায়। দিনের প্রথমভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের ৪০ শতাংশ এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৩৯ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে সন্ধ্যা বা রাতে মৃত্যু হয়েছে ২৬৫ জন বা ২০ শতাংশের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১২ জনের পানিতে ডোবার সময় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বর্ষাকালে মৃত্যুর হার বেশি
বর্ষাকাল ও এর আগে-পরের মাসগুলোতে জুন থেকে অক্টোবরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
২০২০ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ১৩২ জন মারা যায় আগস্ট মাসে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল জুলাই মাসে ১২৪ জন।
চলতি বছর জুলাই মাসে ১ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত ১২৮ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মে ও জুন মাসেও শতাধিক করে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই দুই মাসে যথাক্রমে ১১৪ ও ১৪২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়।
একই পরিবারের একাধিক সদস্য পানিতে ডুবে মারা গেছে। গত ১৯ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০৯টি পরিবারের ২৪৫ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ১২১ জন, বাবা-মাসহ ১৬ জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানিসহ ৮ জন, চাচাতো বা খালাতো ভাই বা বোনসহ ৮৫ জন, চাচা-খালাসহ ১৫ জন মারা যায়। উৎসব বা অন্য কোনো সময়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একই পরিবারের বেশিরভাগ শিশু মারা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিবছর সব বয়সী প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।
পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক দিবস
পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যু সারা দুনিয়াতেই একটি বড় সমস্যা। যে কারণে জাতিসংঘও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ-প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
চলতি বছর ২৮ এপ্রিল এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে। আর প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা এটি তোলার পর পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে বাংলাদেশ মিশন ২০১৮ সালে থেকেই কাজ করে।