করোনাভাইরাসে আদালত বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন বাড়ছে মামলার জট, অন্যদিকে বয়সের সীমা পূর্ণ করে বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ায় তৈরি হচ্ছে বিচারক সংকট। ১০ বছর আগে যেখানে সপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন ১১ জন, গত এক দশকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ জনে।
প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারকের অভাবে আপিল বিভাগে এখন একটি মাত্র বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। বর্তমানে যে সংখ্যক মামলা রয়েছে, তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আপিল বিভাগে দ্রুত বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে তিনটি বেঞ্চ গঠন করা দরকার বলে মনে করছেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা বলছেন, সপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগসহ হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে মামলার জটে একসময় বেসামাল হয়ে পড়বে বিচার বিভাগ। তবে আইনমন্ত্রী বলছেন, দেখা যাক।
২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদায়, এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার পদত্যাগ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ায় আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা কমতে থাকে। পরে একসঙ্গে তিনজন বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এর ফলে সে সময়ে সাত বিচারপতি মিলে আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চে বিচারিক কাজ পরিচালনা করে আসছিলেন। এরপর অবসরে চলে যান বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরও দুইজন বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
সম্প্রতি বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী অবসরে গেলে আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা নেমে আসে পাঁচজনে।
পাঁচ বিচারপতি আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনা করে আসছেন।
এই পাঁচজন হলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি নূরুজ্জামান ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ নিয়ে আমি আগেই বলেছি। বর্তমানে বিচার বিভাগে যে পরিমাণ মামলা আছে, তা নিষ্পত্তির জন্য বিচারকের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টও বাড়াতে হবে।
‘কিন্তু দেখা যায় বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের কেন যেন একটা অনীহা মনোভাব আছে। একসময় আপিল বিভাগে বিচারক ছিলেন ১১ জন। সেখানে এখন ৫ জন। আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারক থাকলে তিনটি বেঞ্চ হতে পারত। অথচ সেখানে একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বারবার বলে আসছি, মামলার যে সংখ্যা আছে তা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বা কীভাবে মামলার ভার থেকে কোর্টকে দ্রুত মুক্ত করা যায়, সে জন্য একটা তক্ষক কমিশন করা হোক। সেই কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিচার বিভাগের মামলা নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে পারবে। নতুবা জনগণ হতাশ হয়ে যাচ্ছে, বিচার পাচ্ছে না।
‘করোনার মহামারি, সব মিলিয়ে দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতির তৈরি হবে। করোনা ছাড়াও স্বাভাবিকভাবে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করতে বিচারক সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি করা উচিত সরকার সেটা করছে না। সরকার এখানে চরম অবহেলা দেখাচ্ছে। এর ফলাফল ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
‘সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন বিচার না পাওয়ার ধারণা সৃষ্টি হবে তখন একটি অরাজকতা সৃষ্টি হবে। দেশের জন্য এটা শুভ হবে না। দেশে যদি আইনের শাসন সঠিকভাবে না থাকে তাহলে সেখানে উন্নয়নের শুভ প্রতীকার মানুষ পায় না।’
আরেক সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, অবশ্যই বিচারক নিয়োগ দেওয়া দরকার। আপিল বিভাগে তিনটা বেঞ্চ হওয়া উচিত। এটি অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, মামলার জট কমাতে হলে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে শুনানি করতে হলে বিচারক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এটা শুধু আপিল বিভাগের জন্য নয়। হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এটা অনেক দিন আগেরই দাবি।
মুনসুরুল আরও বলেন, ‘আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ তো হাইকোর্ট বিভাগ থেকেই যাবে। ফলে হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া দরকার।’
যোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলমতনির্বিশেষে দক্ষ, যোগ্য, সৎ ব্যক্তিকেই বিবেচনা করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চ পরিচালনার জন্য বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া দরকার। আশা করছি অচিরেই বিচারপতি নিয়োগ দেবে সরকার। লকডাউনের কারণে হয়তো হচ্ছে না। লকডাউন উঠে গেলে আশা করি বিচারপতি নিয়োগ হবে।’
বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি জানি, আপিল বিভাগে বর্তমানে পাঁচজন বিচারপতি আছেন। দেখা যাক কী করা যায়।’
শিগগিরই নিয়োগ হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘দেখি।’
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ১০ বছর আগেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শুরুতেও আপিল বিভাগে ৯ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। ওই বছরের ১৪ মার্চ বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও ৭ জুলাই বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে যান। এরপর ওই বছরের শেষের দিকে এসে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি মারা যান বিচারপতি বজলুর রহমান ছানা। আর ফেব্রুয়ারি মাসে পদত্যাগ করে আরেকজন বিচারিপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এর ফলে আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ জনে। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় পাঁচজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলেও অনেক বিচারপতি অবসরে যাওয়ায় এখন বিচারপতির সংখ্যা আবার ৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
আপিল বিভাগে কতজন বিচারপতি থাকবেন?
সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির পরামর্শ ও প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময়ে বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনজন বিচারপতি নিয়ে আপিল বিভাগে বিচারকাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত করে সরকার। ১৯৯৫ সালে আপিল বিভাগে চতুর্থবারের মতো বিচারক সংকট দেখা দিয়েছিল। এর আগে ১৯৭৩, ১৯৭৮ ও ১৯৮৫ সালে আপিল বিভাগে চারজন করে বিচারপতি কর্মরত ছিলেন।
সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকের সংখ্যা নির্ধারণ ও নিয়োগ করে থাকেন।
ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতি (যিনি ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত হইবেন) এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যে সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনবোধ করবেন, সেই সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হইবে।’ সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত বিচারপতি পদে থাকা যায়।”