ঈদ শেষে নওগাঁ থেকে ঢাকায় আসার প্রধান ভরসা বাসের কাউন্টারগুলোতে ভিড় এখন উপচে পড়া। যারা আগাম টিকিট করে রেখেছিলেন, তারা স্বস্তিতে, তবে যাদের টিকিট কাটা নেই, তাদের যাত্রা হয়ে গেছে অনিশ্চিত।
নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি দিয়েও মিলছে না টিকিট। মহামারির মধ্যে নিষিদ্ধ থাকলেও বাসে প্রতি আসনে যাত্রী তুলেও পূরণ করা যাচ্ছে না চাহিদা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে সারা দেশেই মানুষের অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার, যা এবার পরিচিতি পেয়েছে শাটডাউন নামে। তবে ঢাকার সঙ্গে যোগযোগ আরও আগে থেকেই বন্ধ ছিল গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায়।
এই পরিস্থিতিতে এবার ঈদে বাড়ি যাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে সরকার হঠাৎ করেই ১৫ জুলাই থেকে আট দিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করে। চালু হয় গণপরিবহন।
সে সময় জানিয়ে দেয়া হয়, ২৩ জুলাই থেকে আবার বন্ধ হয়ে যাবে মানুষের চলাচল, বিপণিবিতান, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর আগে ২০২০ সালের সাধারণ ছুটি ও গত এপ্রিল থেকে লকডাউন ও ১ জুলাই থেকে শাটডাউনে পোশাক কারখানা বন্ধ না থাকলেও এবার বন্ধ থাকবে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়।
অর্থাৎ ঈদে বাড়ি গেলে উৎসবের পর দিনই ফিরতে হবে, এটা জানিয়ে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ২৭ জুলাই ভোর পর্যন্ত শিথিল থাকবে বিধিনিষেধ। আর সেই গুজবে আস্থা রেখে এখন ভোগান্তিতে হাজারো মানুষ।
নওগাঁয় দূরপাল্লার বাসের কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের অপেক্ষা। ছবি: নিউজবাংলা
বিধিনিষেধ শুরুর আগের দিন সরকারের পক্ষ থেকে আবার জানানো হয়েছে, শুক্রবার ভোর থেকে আবার শাটডাউন শুরু হচ্ছে। আর এবার আগের চেয়ে কঠোর থাকবে পুলিশ।
এই অবস্থায় কেবল নওগাঁ নয়, ঢাকামুখি সব যাত্রাতেই ভোগান্তি চরমে উঠেছে। যাত্রীর তুলনায় যানবাহন কম, টিকিটের জন্য হাহাকার-এই বাস্তবতায় দূরের যাত্রাতেও মহাসড়কে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলারে চেপেছেন হাজার হাজার যাত্রী, তাতেও ভাড়া লাগছে কয়েক গুণ।
কয়েক গুণ ভাড়া, তাও প্রতি আসনে যাত্রী
নওগাঁ থেকে ঢাকা পথের যাত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমি গত মঙ্গলবার অগ্রিম টিকিট কেটেছি। অন্য সময় টিকিটের মূল্য ৪৫০-৫০০ টাকা হলেও আমি ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছি। আবার দুই সিটে এক জন যাত্রী যাবার কথা থাকলেও ডাবল করে যেতে হচ্ছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাস ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর ৩টার দিকে বাস ছেড়েছে।’
ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের বেলা একটার বাসের টিকিট কেটেছেন মো. বক্কর। তিনি বলেন, ‘ছুটির পর ঢাকা যাওয়া একটা চ্যালেঞ্জ। করোনা আর লকডাউনে এইবার সেই চ্যালেঞ্জ অন্য মাত্রায়।’
জেলার রাণীনগরের রবিউল ইসলাম ঢাকার একটি পেট্রল পাম্পে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের দিন হামরা গ্রামের বড়িত আচিছি আবার আজক্যাই যাওয়া লাগবে। কিন্তু হামরা কোনো টিকিটই পাচ্চি না।
‘কালকা থাকা কামোত জয়েন করা লাগবে। আজ না গেলে সমস্যাত পড়া লাগবে। কী করমু একন বুঝবার পারিচ্ছি না। আর ২-৩দিন পর যদি লকডাউন দিত, তালে হয়ত হামরা কোনোভাবে যাবার পারনুনি।’
শাহ ফতেহ আলী বাস কাউন্টারের ম্যানেজার আজাদ হোসেন বলেন, ‘ঢাকামূখী যাত্রীদের বেশি চাপ। তাই অনেক বাসে দুই সিটে একজন করে যাত্রী যাওয়ার কথা থাকলেও যাত্রীদের কথা ভেবে দুই সিটে দুইজন করে যাত্রী নিয়ে যেতে হচ্ছে।’
নওগাঁয় দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হলেও যাত্রী নেয়া হচ্ছে সব সিটে
শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার রানা হোসেন দুই সিটে দুই যাত্রী নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা দুই সিটে এক যাত্রীই নিচ্ছি।’
আর অতিরিক্ত ভাড়ার নেয়ার কথা বললে তিনি বলেন, ‘দেখুন আমরা অন্য সাইট থেকে ৪০ সিটের বাস ভাড়া করেছি ৪০ হাজার টাকা দিয়ে। তাই যাত্রীদের কাছ থেকে ১ হাজার ২০০টাকা করে ভাড়া নিতে হচ্ছে। বাস ভাড়া, স্টাফ খরচ বিবেচনা করেই একটু বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।’
জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি এহসান রেজা বলেন, ‘ঢাকামুখী যাত্রীদের খুব ভিড়। তাদের কথা বিচেনা করে অনেক বাসে দুই সিটে দুই জন করে যাত্রী নিয়ে যেতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত বাস ঢাকায় যাবে। তবে তার পর আর কোন বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে না।’
টেম্পো, অটোরিকশায় ঢাকায় ফেরা
বরিশালের বাস টার্মিনাল ও লঞ্চ ঘাটে টিকিট নেই বলে যাত্রীরা অনন্যোপায় হয়ে তিন চাকার ধীরগতির যানে চাপছেন। টেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মাহেন্দ্রে করে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়েছেন তারা। এমনিতে মহাসড়কে এসব গাড়ি চলাচল করতে দেয়া হয় না। তবে এখন চলছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বরিশাল লঞ্চ ঘাটে ছিল উপড়ে পড়া ভিড়। কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামে দুপুরের পর থেকে।
টার্মিনাল নথুল্লাবাদে কথা হয় সাকুরা বাস কাউন্টারের সামনে টিকেটের জন্য অপেক্ষমাণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘জরুরিভাবে ঢাকা যাওয়া প্রয়োজন। তবে সব লঞ্চ কাউন্টার ঘুরে এখন বাস কাউন্টারে এসেছি। কোনো টিকেট নেই। এখন বিকল্প চিন্তাভাবনা করছি।’
মাওয়ার উদ্দেশে থ্রি হুইলারে ওঠা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘কোনো জায়গায় টিকিট পাইনি। এখন বাধ্য হয়ে এই থ্রি হুইলারে উঠেছি। জানি রিস্ক আছে, তবে কিছু করার নেই। যেতে তো হবে।’
আরেক যাত্রী বলেন, ‘বাস লঞ্চে তো টিকিটই পাই নাই। বর্তমানে থ্রি হুইলারটাই সোনার হরিণ। থ্রি হুইলারে প্রতি জনের থেকে ৮০০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে।’
বরিশালে টিকিট নিয়ে কাউন্টারে যাত্রীদের ভিড়
বরিশালের সুন্দরবর, এডভেঞ্চার, সুরভী ও কীর্তণখোলা লঞ্চ কাউন্টার ঘুরে টিকেট না পাওয়া মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘কোনো কাউন্টারে টিকেট নাই, কাল লকডাউন শুরু হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে।’
ঈগল পরিবহনের কাউন্টার স্টাফ টালু দাস জানান, ‘টিকিট অনেক আগে থেকেই বুকিং হয়েছিল। বাকি কিছু সকালেই শেষ হয়ে গেছে।’
বরিশাল টু মাওয়া রুটের বিএমএফ পরিবহনের কাউন্টারের কর্মী চঞ্চল জানান, সব যাত্রীকে নিতে না পারায় অনেকেই ক্ষিপ্ত হচ্ছেন।
সুন্দরবন লঞ্চের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুর রহমান পিন্টু বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে লঞ্চের টিকেট আগাম বিক্রি করা হয়েছে। কোনো টিকেটই বাকি নেই। ডেক ছাড়া আমাদের কাছে কোনো কেবিনের টিকিটও নেই।’