মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান। একসময় বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি বিমান যোগাযোগ ছিল স্থলবেষ্টিত দেশটির। উজবেক এয়ারে করে দেশটিকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতেন বাংলাদেশি যাত্রীরা। কিন্তু এখন সেই সুযোগ নেই। স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস খুললেও গত ৫০ বছরেও বাংলাদেশে একটি কনসাল অফিসও খোলেনি দেশটি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর তুলা আমদানিকারক ও পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের তুলা ও সুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ উজবেকিস্তানের সঙ্গে নেই ঢাকার তেমন কোনও বাণিজ্যিক সংযোগ। এত দিন পর সেই সংকটের সমাধান হতে যাচ্ছে। উজবেকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে এমনটি জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, বিমান যোগাযোগসহ নানা বিষয়ে উজবেকিস্তানের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে উজবেকিস্তান গার্মেন্টস, টেক্সটাইলসহ অন্যান্য বিষয়ে যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ দেখিয়েছে।
তাসখন্দ সফর নিয়ে আব্দুল মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তো গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান কানেক্টিভিটি অপরচুনিটি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ সম্মেলনে। প্রায় ৪০টি দেশের ২৫০ জনের বেশি প্রতিনিধি সেখানে গিয়েছেন। তাদের দেশ ছাড়া আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সরকারপ্রধানরা সেখানে গেছে। ৪০টি দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা গেছেন। এটা খুব ভালো হয়েছে। এটা তো আমাদের জন্য ভালো। আমরা সেই সুযোগ নিলাম। এই ইস্যুটা তো আমাদের।
‘কারণ, আমরা তো কানেক্টিভিটির নেতা। ইস্যুটা তো আমাদের খুব ক্লোজ। সাউথ এশিয়ায় তো আমরা কানেক্টিভিটির নেতা। তারা এখন সাউথ এশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়ার মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়াতে চায়। তারা আমাদের লাইন ধরে এগোতে চায়। কাজ করতে চায়। আমি খুব আনন্দিত।’
মোমেন বলেন, ‘ওই সম্মেলেনে যোগ দিতে পেরে আমি বা আমরা এক্সাইটেড। আমি তাদের রাষ্ট্রপতিকে বললাম, আপনারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, এতে আমরা খুব আনন্দিত। কারণ, আমরা এর মাস্টার, নেতা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই কানেক্টিভিটি ধারণার জননী। তিনি এটাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি কানেক্টিভিটির নেতা। আমরা এর ফলও পেয়েছি। আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের যত সমস্যা, সব সমাধান হয়ে গেছে। একটা বুলেটও ছুড়তে হয়নি। সমাধান হয়ে গেছে। আমাদের ট্রেডও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, একা একা উন্নতি হলে হবে না। সবাইকে নিয়ে উন্নত হতে হবে। দেশে কিংবা বিদেশে, সবাইকে নিয়ে উন্নতি হতে হবে। উদ্যোগটা ভালো।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘উজবেকিস্তানের সঙ্গে আমাদের মানে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা ইমাম বুখারি, ইমাম তিরমিজি, ইবনেসিনা, সম্রাট বাবরের কাহিনি সব সময় শুনি। গ্রাউন্ড রেডি আছে। এখন বাকিটা শুধু করলেই বাকি সম্পর্কটা এগিয়ে যাবে। এটা উদ্যোগের ব্যাপার।
‘আমরা পৃথিবীর এক নম্বর তুলা আমদানিকারী দেশ। গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দ্বিতীয়। আপনাদের তুলা খুব ভালো। কিন্তু আমাদের আমদানির পরিমাণ কম। কানেক্টিভিটিটা হলে পরে আপনারও লাভ, আমাদেরও।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের তুলা ও সুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ উজবেকিস্তান। ছবি: নিউজবাংলা
বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আগে উজবেক প্লেন ঢাকা যেত। আমরা তাতে করে লন্ডন, আমেরিকা গেছি। অনেক দিন হলো এটা বন্ধ। দেশ স্বাধীনের চার বছরের মাথায় আমরা অ্যাম্বাসি খুলেছি তাসখন্দে। এত বছরেও আপনারা ঢাকায় অ্যাম্বাসি খোলেন নাই। দেখেন আমাদের জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে আপনাদের দেশে এসেছেন এবং একটি হিস্টোরিক ইভেন্ট করেছেন।
‘তাদের রাষ্ট্রপতিকে আমি বলেছি, কিন্তু তাই কানেক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য সবার আগে আমি দুইটি জিনিস চাইব। একটি হলো, আমাদের অনেক ট্যুরিস্ট আছে, যারা জিয়ারত করতে যায়। ভারতে আমাদের ২৮ লাখ লোক বেড়াতে যায়। (কোভিডের আগে)। আপনি দুটো কাজ করতে পারেন। অ্যাম্বাসি খোলেন এবং সরাসরি বিমান চালু করেন। তাহলে কানেক্টিভিটি বাড়বে। ট্যুরিস্ট আসবে। ব্যবসা বাড়বে। আমরা কয়েকটি ব্যবসা ভালো করছি। তার একটি হলো ফার্মাসিউটিক্যালস।’
মোমেন বলেন, উনি এসব শুনেছেন। এর ফলাফলও হয়তো আসবে। মঙ্গলবার ফেরার আগে, গত রোববার আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশিদের নিয়ে। উজবেকিস্তানের লোকেরা সেখানে বাংলা গান গাচ্ছিলেন। সেখানে সবাই খালি গলায় গান গাচ্ছিলেন। সেই সময় কোনো ঘোষণা ও কোনো ধরনের দাওয়াত ছাড়াই ৫ মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।
‘এদের মধ্যে ছিলেন আইটি মিনিস্টারসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ডেপুটি মিনিস্টার ও স্টেট মিনিস্টার। তারা আসার আগে বলে আসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমি যে ইস্যু রেইস করেছি সে বিষয়ে। এরা এসে বলল এই মুহূর্তে অ্যাম্বাসি না খুললেও তারা একটা ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমি তাদের বলেছি আমাদের অনেক ইয়াং লোক আছে। তারা হার্ডওয়ার্কার। আইটি বিশেষজ্ঞ আছে ৬ লাখ। যারা বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সিং করে সুনাম অর্জন করছেন। আপনারা তাদের নিতে পারেন। কারণ, কানেক্টিভিটির জন্য আইটি খুব জরুরি।
বাংলাদেশে আইটি বিশেষজ্ঞ আছে ৬ লাখ, যারা বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সিং করে সুনাম অর্জন করছেন। ছবি: নিউজবাংলা
‘তাদের আইটি মিনিস্টার সে সময় এসেছিলেন। তাকে বললাম, আমাদের আইটি মিনিস্টারের সঙ্গে তার কানেকশন করিয়ে দেব। আমরা আইটির মাধ্যমে টাকাপয়সা লেনদেন করি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিই। বিকাশের মাধ্যমে, ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে। আইটির মাধ্যমেই আমাদের সব ব্যাংক চলে। আমাদের এক্সপার্টরা এসে আপনাদের সব শিখায়ে দেবে। আমরা কেবল নিজেরাই না, সাউথ এশিয়ায় অনেককেই, বিশেষত নেপালকে শিখায়ে দিয়েছি..।’
তিনি বলেন, ‘তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারশনের সভাপতি এসেছিলেন। তিনি স্টেট মিনিস্টার। আমি তাকে বললাম, আমি কোন ব্যবসায়ী না। তবে আমি ফার্মাসিউটিক্যালের লোকদের সঙ্গে কানেকশন লাগাইয়া দেব। লাইন লাগায়া দেব। আমরা ১৪০টি দেশে ফার্মাসিউটিক্যালস রপ্তানি করি। আমরা আমেরিকাতেও এই কোভিডে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়েছি।
‘তারা রোডম্যাপ চায় আমাদের কাছ থেকে। তাদের রাষ্ট্রপতি রোডম্যাপ চান। তারা কীভাবে এগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। এ জন্যই তিনি তার পাঁচ মন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। তারা হেলথকেয়ারেও সাহায্য চাচ্ছেন। তারা টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহী। তুলা রপ্তানি নিয়েও কাজ করতে চায়। আমি বলেছি, আমি বিজনেসম্যান নই। তবে আমাদের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে লাইন লাগায়ে দেব। তাদের যুবমন্ত্রী ও এসেছিল। তাদের রাষ্ট্রপতি আমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে খুব সিরিয়াস। আমরা গান-বাজনা বন্ধ করে দিয়ে তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে নিলাম।’