করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বন্ধ মাদ্রাসা। এর মধ্যে চলে এসেছে কোরবানির মৌসুম। চামড়া সংগ্রহ আর ব্যবস্থাপনা কারা করবে, এ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় কর্তৃপক্ষ।
মাদ্রাসায় আয়ের কোনো নির্দিষ্ট উৎস নেই। কোরবানির সময় দান করা চামড়াই একটি বড় উৎস। সেটি যদি সংগ্রহ করা না যায়, তাহলে পড়তে হতে পারে অর্থকষ্টে।
মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় রোজা ও ঈদুল ফিতর ঘিরে যে আয়, সেটিও হয়নি। এই অবস্থায় ঈদুল আজহায় যদি আয় না হয়, তাহলে শিক্ষকদের বেতন দেয়া কঠিন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা পরিচালকরা। বলছেন, অর্থকষ্টে ঈদের আগে বোনাস তো দূরের কথা, বেতনও ঠিকঠাক মতো দেয়া যায়নি।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির পক্ষ থেকে দুটি দাবির একটি ছিল মাদ্রাসাগুলো খুলে দেয়া। মূলত ঈদুল আজহা সামনে রেখেই এই দাবি জানিয়েছিলেন তারা। তবে শাটডাউনে থাকা দেশে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করাকে ঝুঁকি হিসেবেই দেখছে সরকার।
দারুল উলুম দেওবন্দের রীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত স্থানীয় সাহায্য, অনুদান ও শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারি অনুদান তেমন গ্রহণ করে না ওই মাদ্রাসাগুলো।
গত ৬ এপ্রিল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনে কওমি মাদ্রাসাসহ দেশের সব ধরনের মাদ্রাসা (এতিমখানা ছাড়া) বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় সরকার।
মাদ্রাসার আর্থিক সংকট কতটা, সেটি গত রোজায় দেশের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা হাটহাজারীর কর্তৃপক্ষের ফেসবুকে এসে সহযোগিতা চাওয়াতেই বোঝা যায়।
রাজধানীর আদাবরের হোসেইনিয়া নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রিন্সিপাল হাফেজ দবির উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মহল্লার সঙ্গে যাদের আন্তরিকতা আছে তাদের অনেকে বলেছেন, কোরবানি যদি দিতে পারি, চামড়ার দাম যাই থাকুন আপনি গিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু মাদ্রাসা তো বন্ধ আমাদেরও সে পরিমাণ লোকের অভাব।’
তিনি বলেন, ‘কেবল চামড়া সংগ্রহ না। এলাকার কোরবানির বড় অংশই তো মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরাই দিয়ে থাকে। আমরা যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াই তাহলে একসময় মানুষই বলবে যে আপনারা তো আসেননি, এখন আর আমাদের প্রয়োজন নেই। এ জন্যই আমাদের মানুষের পাশে থাকতে হবে।’
মাদ্রাসার আর্থিক পরিস্থিতি কেমন এমন প্রশ্নে দবির উদ্দিন বলেন, ‘মাদ্রাসা চলে অর্থশালীদের দানে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে আমরা পড়েছি। শিক্ষকদের মধ্যে যাদের বেতন ১২ হাজার ছিল এখন তাদের ৫ হাজার টাকা দিয়ে বলেছি, স্বাভাবিক অবস্থা হলে আবার আগের অবস্থায় চলে যাব। এভাবে আমরা সমন্বয় করে নিয়েছি। শিক্ষকরাও সংকটটা বুঝতে পারছেন। তবে সাংসারিক সংকট তো থেকেই যাচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’
রংপুরের জুম্মাপাড়ার আল জামিয়াতুল করীমিয়া নূরুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম ইদরিস আলীও বলেন একই কথা। বলেন, ‘মাদ্রাসা বন্ধের কারণে কোরবানির মৌসুমে আমরা বিশাল সংকটে আছি। শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। তারা কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। রমজান থেকে এভাবেই চলছে। এখন কত দিন চলবে আল্লাহ পাক জানেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এবার চামড়া সংগ্রহ করার চেষ্টা করব। স্বাভাবিক সময়ে যেমন হয় তেমন হবে না।’
ছাত্র না থাকায় চামড়া এবার সংরক্ষণ করা যাবে না বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘চাড়মায় লবণ দেব না, সরাসরি বিক্রি করে দেব। এবার আমরা ছাত্র জোগাড় করতে পারতেছি না। এ কারণে যতটুকু পারা যায় সেভাবেই কাজ করব।’
চামড়ার দাম গত কয়েক বছর ধরেই ছিল মন্দা। এবার করোনা পরিস্থিতিতে কী হয়, তা নিয়েও চিন্তিত এই মাদ্রাসাশিক্ষক। অর্থসংকটে কোরবানির সংখ্যা কমে যায় কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তিনি। বলেন, ‘আমাদের প্রতিবছর গরুর হাজার খানেক চামড়া হয়, আর ছাগলের হয় ৬০০-এর মতো। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে অনেক কম হবে।’
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফতেপুর মাদ্রাসার আলেম মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এখন তো চামড়ার দাম নেই। এ জন্য আমরা চামড়া সংগ্রহ করে আর লবণ দিই না। লবণ দিতে গেলে যে খরচের টাকাই উঠবে না। গত বছর আমরা চামড়া ২৩০ টাকায় বিক্রি করছি।’
লালমনিরহাটের হাড়ীভাঙ্গা তালিমুল ইনসান হাফেজিয়া ও কওমি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক নূর আলম সিদ্দিক বলেন, ‘মাদ্রাসা বন্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে ছাত্রদের। তাদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে। ধর্মীয় শিক্ষার যা কিছু আগে পড়েছে তা ভুলে যাচ্ছে। আবার তাদের নতুন করে পড়ানোর জন্য তৈরি করতে হবে।’
পাবনার চাটমোহরের আয়শা সিদ্দীকা বালিকা কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি মাহমুদুল হাসনান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউনে মাদ্রসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে আমরা ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন পাইনি। সে কারণে আমরা শিক্ষকদের বেতন দিতে পারি না।‘